স ম জিয়াউর রহমান, চট্টগ্রাম থেকে :
আমেরিকার নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘নর্থ আমেরিকান মুসলিম অ্যালায়েন্স’ এর দুই দিনব্যাপী ইসলামিক কনভেনশনে মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ দরবারে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর গাউসিয়া হক মনজিলের সাজ্জাদানশীন ও শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ট্রাস্টের মাননীয় ম্যানেজিং ট্রাস্টি রাহবারে আলম হযরত শাহ্ সুফি সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভাণ্ডারী (ম.)’র বক্তব্য-
ডা. বরুণ কুমার আচার্য্য বলাই :
আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এই সম্মেলনের গুরুত্বের দিকে। কেন এই সম্মেলন এত গুরুত্বপূর্ণ? প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন বৈজ্ঞানিক, রাজনীতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নতুন রূপ ধারণ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জেনেটিক্স আমাদের প্রচলিত চিন্তাভাবনাকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করছে, সীমান্তভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং বিশ্বায়ন একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত।
প্রতিদিন আমাদের পরিচিত ধ্যান-ধারণা বদলে যাচ্ছে এবং মুসলিম উম্মাহর দুই বিলিয়নেরও অধিক মানুষকে এই দ্রুত পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। অথচ আরেক দিকে একটি উম্মাহ হিসেবে বিশ্বজুড়ে আমরা এখনো অধিকাংশ মানুষের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা বহু বিষয়ে অনিশ্চিত, বহু বিষয় আমরা অমীমাংসিত রেখে দিয়েছি।
সমসাময়িক বিশ্বের অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্তহীন। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে, যাদের নিরাপত্তা আমরা দিতে পারছি না।অনেক ক্ষেত্রেই আস্থা, বিশ্বাসের অভাব উম্মাহর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে ইন্ধন জোগাচ্ছে। উম্মাহর মধ্যে দ্বন্দ্বপূর্ণ বিভাজন আমাদের ভেতর থেকে ধ্বংস করছে।
এতসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা কিছু নির্বোধ প্রশ্ন শুনতে পাই, “আপনারা ত্বরিকা নিয়ে কথা বলেন কেন? কেবল ইসলামের কথা বললেই তো পারেন। কুরআনের রেফারেন্সই তো যথেষ্ঠ, কেন আপনারা সুফিদের, সুফিবাদের আলেমদের রেফারেন্স টানেন?”
দেখা যায় যে, এই প্রশ্নগুলি কিছু গভীর বিষয়কে অতি সরলিকরণ করার মানসিকতা থেকে আসে। এটি বিশ্ব পরিস্থিতির জটিলতা এবং ইসলাম কর্তৃক প্রদত্ত এর সূক্ষ্ম এবং বৈচিত্র্যময় সমাধান সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির অপ্রতুলতাকে ইঙ্গিত করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বেশির ভাগ সময় দেখা যায় এই সরলিকরণপন্থীরাই উম্মাহর উপর আধিপত্য করে।
কিন্তু ইসলাম কি আমাদের সামাজিক বা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে এই ধরনের সংকীর্ণ একমাত্রিক দৃষ্টিকোণে সীমাবদ্ধ থাকতে উৎসাহিত করে? না, ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। আমরা মদিনাতুল মুনাওয়ারায় দেখেছি, সেখানে একই সময়ে সাতজন ফকীহ ছিলেন। তাঁদের মাঝে মতভেদ ছিল, কিন্তু কেউ কাউকে বাধাগ্রস্ত করেননি। তাঁরা নিজ নিজ আসনে বসেই শিক্ষাদান চালিয়ে গেছেন।
আরও পড়ুনঃ দিনাজপুর জেলা পুলিশ কর্তৃক গত ১২ ঘন্টায় ফ্যাসিস্ট নাশকতার পরিকল্পনাকারী ৪৫ জন সহ ১০২ জন গ্রেফতার
এখানে শাহরাস্তানির ‘কিতাব মিলাল ওয়ান নিহাল’র একটি উদাহরণ উল্লেখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি যখন মুতাযিলা মতবাদ আবির্ভূত হয়, এর প্রবক্তা ছিলেন ওয়াসিল ইবনে আতা। তিনি একবার একটি মসজিদে ইমাম হাসান বসরীর সঙ্গে মতভেদে জড়ান। ইমাম হাসান বসরী মসজিদে দারস (পাঠ) দান করতেন। এক পর্যায়ে ওয়াসিল ইবনে আতা কিছু পয়েন্টে তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন।
তখন ইমাম হাসান বসরী বলেন, ‘ই‘তাজাল আন্না’ অর্থাৎ ‘তুমি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাও’। তাঁর কথা অনুযায়ী তাঁর বাকি জীবদ্দশায় ওয়াসিল ইবনে আতা অন্যত্র সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো- তিনি সেই মসজিদেরই অন্য এক স্তম্ভের পাশে বসে নিজ চিন্তাধারা শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এই ছিল আমাদের গৌরবময় অতীতের চিত্র — মাজহাবের উত্থান, মতবাদের পারস্পরিক সহাবস্থান। বর্তমানে চারটি মাজহাব প্রচলিত থাকলেও অতীতে ১০টিরও বেশি মাজহাব বিদ্যমান ছিল।
ত্বরিকাও এসেছে এই ধারাবাহিকতায়। এসব মাজহাবের উত্থান, সত্যের উত্থান, ত্বরিকার উত্থান আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ভিন্নমতকে আমরা শ্রদ্ধা করতে পারি। আমরা সুন্দর শান্তিপূর্ণভাবে একটি বহুত্ববাদী সমাজে সামগ্রিকভাবে সহাবস্থান করতে পারি। আমাদের অতীতের আলেমগণ কোন বাইনারি সিস্টেম (১ অথবা ০) জারি করেননি। তাঁরা জানতেন যে মতবৈচিত্র্যের একটি কারণ আছে এবং ফিতরত (সহজাত প্রবৃত্তি) বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁরা সমাজকে কালো-সাদা হিসেবে নয়; বরং একটি প্রিজমের মত করে দেখেছেন, যার অনেক রং, অনেক দিক রয়েছে। তাঁরা ইসলামের আধ্যাত্মিক দিকটি বোঝার উপর জোর দেন। কারণ এই আধ্যাত্মিক বোঝাপড়া ছাড়া একজন মুসলিমের মন হয়ে ওঠে যান্ত্রিক, বস্তুবাদী। তাসাওউফ আমাদের সেই আত্মিক দিকটির উপর আলোকপাত করে এবং শেখায় নৈতিকতা, আখলাক, আধ্যাত্মিকতা এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপনের উপায়।
আজ এখানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমাদের সম্মানিত অতিথিগণ যেমন, শায়খ নুর কাব্বানী, শায়খ নিনবী, শায়খ বুখারী, শায়খ কফিলউদ্দিন সরকার সালেহী নিশ্চয়ই এই বিষয়ে আলোকপাত করবেন, দিকনির্দেশনা দিবেন, উত্তর দিবেন এবং আমাদের এই কঠিন সময়ে টিকে থাকার সাহস ও আশা যোগাবেন।
আমি বিশ্বাস করি এই সম্মেলনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে এবং উম্মাহকে এই করুণ অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদেরকে যুক্তিসঙ্গত দিকনির্দেশনা প্রদান করে যাবে। আমি আবারও সকলকে ধন্যবাদ জানাই, বিশেষ করে আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, আমাকে এই অনুষ্ঠানের অংশ হওয়ার সুযোগ প্রদানের জন্য। আমার জন্য দোয়া করবেন, আমাদের ত্বরিকার ভক্তদের জন্য দোয়া করবেন, যেন আমরা আপনাদের পাশে থেকে উম্মাহর সেবা করতে পারি এবং যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একসঙ্গে অবদান রাখতে পারি, ইনশাআল্লাহ। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
সংগ্রহ ; গাউসিয়া হক কমিটি বাংলাদেশ।