ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*ইজতিহাদের প্রকৃতি: ওহী ভিত্তিক নাকি ব্যক্তিগত মত? — ফতোয়া গ্রহণে দলীল জানার প্রয়োজনীয়তা*
_অসাধারণ প্রশ্ন করেছেন শামসুদ্দিন ভাই। অত্যন্ত গভীর ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্পর্শ করেছেন তিনি। নিচে একটি একাডেমিক, সহজ ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করা হলো:_
শামসুদ্দিন ভাই, আপনার প্রশ্ন একেবারেই ইসলামী আইনশাস্ত্র ও চিন্তার মূল কেন্দ্রে আঘাত করেছে। আপনি যে দুইটি প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলো:
_১. ইজতিহাদ কি ওহী ভিত্তিক হবে, নাকি একান্ত ব্যক্তিগত মত?_
_২. হারাম বা হালাল ফতোয়া পাওয়াই কি যথেষ্ট, নাকি ওহীর দলীল জানা জরুরি?_
*১. ইজতিহাদের প্রকৃতি: ওহী ভিত্তিক নাকি ব্যক্তি চিন্তাভিত্তিক?*
আরও পড়ুনঃ পাবনায় স্বাস্থ্য সহকারীদের ৬ দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন
ইজতিহাদ মানে শ্রমসাধ্য চিন্তাভাবনা, গবেষণা ও অনুসন্ধান, যার লক্ষ্য হলো কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ থেকে দলীল বের করা, বিশেষত এমন নতুন বিষয়ে যেখানে সরাসরি স্পষ্ট কোনো দলীল নেই। ইজতিহাদ কখনোই সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যক্তিগত ধারণা হতে পারে না।
বরং, এটি ওহী (কুরআন ও সুন্নাহ) ভিত্তিক নীতিমালা, মূলনীতি (উসূল) এবং কায়দা (Qawaid)-এর আলোকে করা হয়।
যেমন, কুরআনে বলা হয়েছে: “যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্ব রাখে, তাদের আনুগত্য কর। আর যদি কোনো বিষয়ে মতভেদ কর, তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে নাও।” (সূরা নিসা, ৪:৫৯)! অতএব, ইজতিহাদের ভিত্তি: কুরআন ও সুন্নাহ। প্রয়োজন ও মসালাহাহ কিন্তু কখনোই খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে না।
*২. ফতোয়া গ্রহণ ও ওহীর দলীল জানার প্রয়োজনীয়তা:* আপনি অত্যন্ত সঠিক বলেছেন, শুধু “হারাম” বা “হালাল” শোনা যথেষ্ট নয়।
ফতোয়া গ্রহণ করতে গেলে জানা উচিত, তার পেছনে কী দলীল আছে। কুরআন ও সুন্নাহ আমাদের বিচক্ষণতা (تدبر) এবং অনুসন্ধানের শিক্ষা দিয়েছে।
যেমন ইমাম আবু হানিফা বলেছেন: “কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রমাণ না জানলে, আমার কথা গ্রহণ করো না।”
আপনি যে উদাহরণ দিয়েছেন (MLM)—দারুণ প্রাসঙ্গিক। MLM-এর মধ্যে অনেকক্ষেত্রে জুয়ার সাদৃশ্য, প্রতারণা, হক আত্মসাৎ, অস্পষ্টতা (Gharar) থাকে।
তাই আলেমরা ওহীর মূলনীতি থেকে দলীল দিয়ে হারাম বলেছেন। যেমন: “হে ঈমানদারগণ, একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।” (সূরা নিসা, ৪:২৯)!
_অতএব, মুসলিমদের উচিত:_ (ক). শুধু “ফতোয়া” শুনে থেমে না যাওয়া। (খ). বরং দলীল জানতে চেষ্টা করা। (গ). এতে ঈমান আরও মজবুত হয়, এবং আত্মবিশ্বাস জন্মায়।
*৩. উদাহরণ: টেস্ট-টিউব বেবি (Test Tube Baby/IVF)*
প্রশ্ন: বন্ধ্যাত্ব দূর করতে টেস্ট-টিউব বেবি পদ্ধতি কি বৈধ:
ইজতিহাদের ফলাফল: বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, যদি স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব শুক্রাণু (sperms) ও ডিম্বাণু (ovum) ব্যবহার হয়।
আরও পড়ুনঃ ত্রিশালে ইউপি চেয়ারম্যান আঃ কুদ্দুস মন্ডল গ্রেফতার
কোনো তৃতীয় পক্ষের শুক্রাণু (sperms), ডিম্বাণু (ovum) বা সারোগেসি (ভাড়া করা মহিলা) ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ, ইসলামে বংশ ও পিতৃত্বের পরিচয় স্পষ্ট থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই উদাহরণসহ আরো অনেক ইজতিহাদের উদাহরণ প্রমাণ করে—ইসলাম একটি জীবন্ত, চিন্তাশীল এবং চিরকাল প্রাসঙ্গিক জীবনব্যবস্থা।
ইজতিহাদ ইসলামের সেই সেতু, যা অতীতের শাশ্বত মূলনীতিকে বর্তমানের বাস্তবতার সাথে যুক্ত করে।
*৪. উপসংহার:* ইজতিহাদ একান্তই ওহী ভিত্তিক বিশ্লেষণ। এটি ব্যক্তিগত খেয়ালের বিষয় নয়। আর, ফতোয়া নেওয়ার সময় মুসলিমদের উচিত দলীল জানার চেষ্টা করা, যাতে শরি’য়াত পালন হয় বোধগম্যতা ও বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে, অন্ধ আনুগত্যের ওপর করে নয়।
শামসুদ্দিন ভাইয়ের এই প্রশ্ন আমাদের সকলের জন্য এক মহান শিক্ষা—ইসলাম শুধু মান্যতার নয়, বরং বোঝার জীবন ব্যবস্থা। এভাবেই ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য ও শক্তি রক্ষা পাবে।
(মূসা: ০৮-০৭-২৫)