ড. শেখ আকরাম আলীঃ
একটি দেশের গণতান্ত্রিক চর্চায় নির্বাচনের গুরুত্ব সর্বাধিক। আমরা প্রথমবার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা পাই ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে। তখন ব্রিটিশ ভারতের এগারোটি প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে সাতটি প্রদেশে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বিজয় লাভ করে এবং চারটি প্রদেশে, যার মধ্যে বাংলা ছিল অন্যতম, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়। কংগ্রেস নেহেরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করে।
শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক বাংলার প্রথম মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী হন। ভারতের মুসলিম জনসাধারণ কংগ্রেস সরকারের কেন্দ্রীয় শাসন থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং অবশেষে একটি পৃথক ভূখণ্ডের দাবি তোলে, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয়।
আমাদের অঞ্চলে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে, নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকারের অধীনে। সে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠন করে। এটিকে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে ধরা হয়।
আরও পড়ুনঃ পাঁচবিবিতে ১৭ জন প্রতিবন্ধীর মাঝে হুইলচেয়ার বিতরন
১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ব্যাপক বিজয় অর্জন করে। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কারচুপির গুরুতর অভিযোগ ছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই আমাদের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা খারাপ হতে শুরু করে।
১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নির্বাচন একদলীয় নির্বাচন সংস্কৃতির জন্ম দেয়। অবশেষে তিনি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে ঐতিহাসিক বাকশাল প্রবর্তনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করেন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার চর্চা বন্ধ করে দেন। ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ছিল শেখ মুজিবের মাধ্যমে একটি খারাপ নির্বাচনী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায়। এর ফলেই ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে মাত্র সাত মাসের মধ্যে তার পতন ঘটে। লেখক সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্র হিসেবে রাজধানীর জনগণের আনন্দঘন অনুভূতি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন এবং ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। মালেক উকিলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরায় রাজনৈতিক দলে রূপ নেয় এবং সংসদে বিরোধী দলে পরিণত হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে জিয়াউর রহমান সৈনিক হয়েও বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই অর্জন তাকে বাংলাদেশের মহান নেতা বানিয়েছে এবং বিশ্ব গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক রাজনৈতিক কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে। গণতন্ত্রপ্রেমী জনগণ কখনোই তার অবদান ভুলবে না। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে আমরা তাকে হারিয়েছি।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে ধরা হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। জাতি তার অবদানকে চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তবে ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং এর ফলেই ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু আবারও বিএনপি-ই দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে। বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের স্বার্থে মহানুভবতার পরিচয় দেন, যেমনটি জিয়াউর রহমান দিয়েছিলেন।
প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়, কিন্তু ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। জনগণ দ্বিদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভিজ্ঞতায় আনন্দিত হয়, যেমনটি বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক দেশে বিদ্যমান।
কিন্তু এক উচ্চাভিলাষী সেনাপ্রধান ব্যক্তিগত স্বার্থে এবং নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কারসাজিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। এর ফলে গণতন্ত্রের চর্চা বন্ধ হয়ে যায় এবং শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন শুরু হয়। তিনি দ্বিধা না করেই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন, যার জন্য তিনি একসময় সংগ্রাম করেছিলেন। তার অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোকে প্রহসন হিসেবে প্রমাণিত করেছে।
বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকারসহ অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং গত পনেরো বছর ধরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে সবচেয়ে খারাপ জীবন কাটায়। পরিবর্তনের আশা জনগণ হারালেও রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছেড়ে দেয়নি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দুটোই পরিবর্তনের জন্য মাঠে সক্রিয় ছিল।
হঠাৎ করেই ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব জনগণকে সব কষ্ট থেকে মুক্তি দেয় এবং নতুন আশা ও স্বপ্ন জাগায়। পুরো জাতি এখন আশাবাদী, শিগগিরই সুন্দর দিন আসবে। তবে শঙ্কা ও উদ্বেগ এখনো কাটেনি। ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার আন্তরিক প্রমাণিত হলেও তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই তাদের পরিপক্কতা প্রদর্শন করতে হবে এবং জুলাই সনদকে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি উত্তম দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, নচেৎ শত্রুরা সুযোগ নেবে।
আরও পড়ুনঃ বগুড়া গাবতলীতে সরকারী বস্তা ব্যবহার করায় ১’শ ৫৬ বস্তা চাল জব্দ
ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক এবং সব রাজনৈতিক দল দলীয় স্বার্থ ভুলে জনগণ ও দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অংশগ্রহণ করুক—এটাই এখন জাতির প্রত্যাশা। শত্রুরা অবশ্যই সরকারের নির্বাচন আয়োজন ব্যাহত করার চেষ্টা করবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে ইতিহাসে সফল নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়। ড. ইউনুস ও তার দলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর এই ঐতিহাসিক নির্বাচন সফল করতে।
ফেব্রুয়ারির নির্বাচন জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করবে। সম্ভাবনা রয়েছে যে বিএনপি বিপুল বিজয় অর্জন করবে এবং পরবর্তী সরকার গঠন করবে। জনগণ এখনো বিএনপির প্রতি আস্থা রাখে। তবে যদি তারা তাদের দায়িত্বে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হবে, যা সহজে পূরণীয় হবে না। এই সংকটময় সময়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং জাতি তাদের কাছ থেকে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকাশের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করছে। এনসিপিকেও সঠিক রাজনৈতিক মনোভাব গ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে এবং অযৌক্তিক দাবি থেকে বিরত থাকতে হবে।
ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। জনগণ ও জাতি এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নিরাপদ ও নতুন বাংলাদেশ লাভের প্রত্যাশায় রয়েছে।