ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করো না। (সূরা বাকারা, আয়াত: ৪২):*
_ভূমিকা:_ সত্য ও মিথ্যা—এই দুটি শব্দ মানব সভ্যতার মৌলিক নৈতিক স্তম্ভকে সংজ্ঞায়িত করে। কুরআনুল কারিমে সত্য (Haqq) কে আল্লাহর নির্দেশনা, সঠিক পথ ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, আর মিথ্যা (Batil) কে ধ্বংসযোগ্য, অন্যায় ও বিভ্রান্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের, বিশেষ করে ইয়াহুদিদের উদ্দেশ্যে সতর্ক করে বলেছেন—সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে উপস্থাপন করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করো না। এটি কেবল তাফসিরমূলক নয়, বরং একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক, নৈতিক ও আইনী নির্দেশনা।
*১. শানে নুযুল (এই আয়াতের অবতরণের প্রেক্ষাপট):*
ইবনে আব্বাস (রা.) এবং মুজাহিদ (রাহি.) বর্ণনা করেন যে, এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয় মদীনায় বসবাসকারী ইহুদিদের সম্পর্কে। তারা কুরআনের সত্যতা ও নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নবুয়তের সত্যতা জানার পরও তা গোপন করত এবং তাওরাতে এসব সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা প্রচার করত। তারা সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করার জন্য সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ ঘটাতো। তাই আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিও না এবং সত্য গোপন করো না।
আরও পড়ুনঃ মাইজভাণ্ডারী গাউসিয়া হক কমিটি বাংলাদেশ ডলু নয়া বাজার শাখার শোহাদায়ে কারবালা মাহফিল অনুষ্ঠিত
*২. এই আয়াতের সদৃশ্য কুরআনের আরও কয়েকটি আয়াত:*
_২.১ সূরা বনী ইসরাঈল, (আয়াত-৮১):_ “বল, সত্য আগত হয়েছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হবারই।”
_২.২ সূরা আল-আনআম, (আয়াত-৮১):_“তোমরা কেমন করে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ভয় করো যা তোমরা শরিক করো, অথচ আমি ভয় করি না তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরিক করছো?”
_২.৩ সূরা আলে ইমরান, (আয়াত-৭১):_ “হে কিতাবধারীগণ! তোমরা কেন সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে দাও এবং সত্য জেনে তা গোপন করো?”
*৩. এই আয়াতের সদৃশ্য কিছু হাদীস:*
_৩.১ সাহীহ বুখারী, (হাদীস-৬০৯৪):_“তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন করো। কারণ সত্যবাদিতা সৎকর্মের দিকে পরিচালিত করে, আর সৎকর্ম জান্নাতের দিকে। মানুষ যখন সত্য বলে এবং সত্য খোঁজে, তখন আল্লাহর কাছে সে ‘সিদ্দীক’ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়।”
আরও পড়ুনঃ দগ্ধ শিশুদের বাঁচানো সেই সাহসিকা নারী শিক্ষিকা মাহরিন চৌধুরী আর নেই!
_৩.২ সাহীহ মুসলিম, (হাদীস-২৬০৭):_ “যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা চালিয়ে যায় এবং মিথ্যা খোঁজে, আল্লাহর কাছে সে ‘মিথ্যাবাদী’ হিসেবে লিখে দেওয়া হয়।”
_৩.৩ তিরমিযী, (হাদীস-১৯৭১):_ “তিনটি বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে থাকবে, সে হবে মুনাফিক… এবং তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে—‘যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে।’”
*৪. আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দর্শনের আলোকে ‘সত্য’ ও ‘মিথ্যা’র বিশ্লেষণ:*
_৪.১ আইনের শাসন (Legal aspect):_ আইন হলো বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি সত্য। সাক্ষ্য যদি মিথ্যা হয়, তাহলে ন্যায়বিচার অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইসলামী শরিয়াহতেও মিথ্যা সাক্ষী কঠোরভাবে নিষিদ্ধ (সূরা নূর, আয়াত ৪)।
_৪.২ নীতি (Policy & Principle):_ সত্যবাদিতা সামাজিক আস্থা তৈরি করে। রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিগত দিক থেকেও সরকার বা প্রশাসনের বক্তব্যে মিথ্যা হলে জনআস্থা ভেঙে পড়ে।
_৪.৩ নৈতিকতা (Ethical Values):_ সত্যের প্রতি আনুগত্য একটি মূল চারিত্রিক গুণ। একজন নৈতিক ব্যক্তি কখনোই মিথ্যার আশ্রয় নেয় না—even if it brings temporary gain.
_৪.৪ মূল্যবোধ (Moral values):_ মুসলিম সমাজের ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাহনির্ভর। এগুলোর মধ্যে সত্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সামাজিক মূল্যবোধের অন্যতম স্তম্ভ সত্য।
_৪.৫ দর্শন (Philosophy):_ ইসলামী দর্শনে সত্য হল আল্লাহর গুণ (আল-হাক্ক)। আল্লাহর অস্তিত্ব, বার্তা ও সৃষ্টি—সব কিছুই সত্য ও বাস্তবতার নিরিখে। সত্যের বিপরীত হল জাহান্নামের পথ।
আরও পড়ুনঃ মৃত্যুর পরও ধামাচাপা – প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত পরিবার
*৫. শিক্ষা ও উপদেশ:*
৫.১ সত্য বলা শুধু একক গুণ নয়, বরং এটি ঈমানের পরিচয়।
৫.২ যারা জেনেশুনে সত্য গোপন করে, তারা সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, যা ফিতনার জন্ম দেয়।
৫.৩ জ্ঞানী ও আলেমদের উচিত সত্য প্রকাশ করা এবং প্রচার করা, নচেৎ তাদের জবাবদিহি করতে হবে (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৫৯)।
৫.৪ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই সত্যই হওয়া উচিত মূলনীতি।
*৬. উপসংহার:* আলোচ্য আয়াতটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সত্যকে গোপন করা এবং মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া একটি গুরুতর অপরাধ, যা সমাজে বিভ্রান্তি ও অন্ধকার সৃষ্টি করে। একজন বিশ্বাসীর দায়িত্ব হল—সত্যের উপর অবিচল থাকা, সত্য প্রচার করা এবং মিথ্যার বিরুদ্ধাচরণ করা। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আমাদের উচিত সত্যকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া, তবেই সমাজ হবে ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ২১-০৭-২৫)