হুইলচেয়ারের গল্প-
আব্দুস সালাম
মল্লিকপাড়ার সবাই জানে—আলভী ভাইয়া অসুস্থ। অনেক দিন ধরে তিনি হুইলচেয়ারে বসে বারান্দায় থাকেন। আশপাশের সবাই যখন হাঁটে, হাসে, খেলে—তিনি চুপচাপ বসে থাকেন আর দেখেন। চোখের ভেতরে কী যেন এক রকমের কষ্ট লুকানো।
একদিন পাশের বাড়ির দবির চাচা এলেন চিন্তিত মুখে। বললেন, “আমার ছেলে নাঈম তো মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য জেদ ধরেছে। না বললেই রেগে যায়, কথা কাটাকাটি করে! কী করব বুঝতে পারছি না।”
আলভী ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন, “চাচা, ওকে একদিন আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। একটু কথা বলব, যদি কিছু বুঝিয়ে বলতে পারি।”
দুই দিন পর, নাঈম তার বন্ধু উজ্জ্বলকে নিয়ে এল আলভী ভাইয়ার বাসায়। ভাইয়া ওদের হাসিমুখে স্বাগত জানালেন, আর বারান্দায় বসতে বললেন। একটু গল্প-গুজবের পর হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা তো আমাকে প্রায়ই হুইলচেয়ারে বসে থাকতে দেখো, তাই না? কখনো জানতে ইচ্ছা হয়েছে, কেন আমি আর হাঁটতে পারি না?”
নাঈম মাথা নাড়ল, “না ভাইয়া, জানতে ভয় লাগত…”
আলভী ভাইয়া একটু চুপ করে থেকে শুরু করলেন, “আমি ছিলাম বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। খুব আদর-ভালোবাসায় বড় হয়েছি। ক্লাস এইটে পড়ার সময় বাবাকে বললাম, ‘একটা বাইক কিনে দাও।’ বাবা বললেন, ‘এখন নয়, কলেজে উঠলে দেব।’ কিন্তু আমি জেদ ধরলাম—‘এখনই চাই!’
আরও পড়ুনঃ ব্যাঙশিয়ালের গীত আব্দুল কাদের
শেষে বাবা রাজি হলেন। বাইক পেয়ে আমি খুব খুশি! বন্ধুবান্ধব নিয়ে রাস্তায় ঘুরতাম, মজা করতাম। বাবা-মা বারবার সাবধানে চালাতে বলতেন। কিন্তু আমি শুনতাম না। ভাবতাম, দুর্ঘটনা আমার সঙ্গে হবে না!”
তিনি গভীর নিশ্বাস নিয়ে আবার বললেন, “এক ঈদের দিন বাবা বললেন, ‘আজ বাইক নিয়ে বের হয়ো না, অনেক ভিড় থাকবে।’ আমি বললাম, ‘ঈদের দিনই তো মজা।’ ওই দিনই হলো সবচেয়ে বড় ভুল।
বাইক চালাতে চালাতে প্রতিযোগিতা করছিলাম। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। অনেক দূরে ছিটকে পড়লাম। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আমি হাসপাতালে। বাবা-মা পাশে কান্না করছিলেন। সবকিছু বিক্রি করে তারা আমার চিকিৎসা করিয়েছেন। জমিজমা, সঞ্চয়—সব চলে গেল।
ডাক্তার শেষমেশ জানালেন, আমি বেঁচে গেছি ঠিকই, কিন্তু আর কখনো হাঁটতে পারব না। এখন আমি নিজে থেকে কিছুই করতে পারি না—না দাঁড়াতে পারি, না হাঁটতে পারি, এমনকি বাথরুমে যেতেও সাহায্য লাগে।
বন্ধুরা, শুধু একটা ছোট জেদ, একটা ভুল সিদ্ধান্ত আমার পুরো জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে। বাবা-মায়ের কথা যদি সেদিন শুনতাম, তাহলে হয়তো আমার জীবন এমন হতো না। এখন আমি শুধু বসে বসে অন্যদের চলাফেরা দেখি… আর আফসোস করি।”
তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “তোমরা কখনো এমন কোরো না। মোটরসাইকেল সময় হলে কিনতেই পারো। কিন্তু প্রতিযোগিতা কোরো না, অহেতুক ঝুঁকি নিও না। আর সবচেয়ে বড় কথা—বড়দের কথা শুনো। একটা ছোট ভুলে জীবনটা এমন হয়ে যাক, এটা আমি চাই না।”
আলভী ভাইয়ার চোখে পানি চলে আসে। তার কথা শুনে নাঈম আর উজ্জ্বল একেবারে চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর নাঈম বলল, “ভাইয়া, আজ আপনার কথা শুনে বুঝলাম আমি কী ভুল করছিলাম। আমি কথা দিচ্ছি, আর জেদ করব না। বাবার সঙ্গে ঝগড়াও করব না। আপনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন—একটা ছোট ভুল কীভাবে পুরো জীবনটা পাল্টে দিতে পারে। আমি চাই না, আমার বাবা-মা আপনাদের মতো কষ্ট পাক।”
====***====
ঠিকানা:
আব্দুস সালাম
সহকারী সচিব
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।