ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া: আইন, নীতি, নৈতিকতা ও দর্শনের আলোকে*
_আমার বন্ধু প্রফেসর ড. শেখ আলীমুজ্জামান জাপান থেকে সুরা হুজরাতের ১৩ নম্বর আয়াতের আলোকে প্রশ্ন করেছেন: “মর্যাদার মূল মাপকাঠি তাকওয়া”- বুঝি নাই, ব্যাখ্যা প্লিজ।_
_ভূমিকা:_ মানুষ জন্মগতভাবে শ্রেষ্ঠ নয়, বরং কর্ম ও চারিত্রিক উৎকর্ষের মাধ্যমে সে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। কিন্তু সমাজে প্রথাগতভাবে অর্থ-বিত্ত, বংশ, বর্ণ, পদমর্যাদা ও ক্ষমতাকেই শ্রেষ্ঠতার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে আল-কুরআনের সূরা হুজুরাতের আয়াত ১৩ এক বৈপ্লবিক বার্তা দেয়: “আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদবান সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান।” এ আয়াত কেবল ধর্মীয় উপদেশ নয়, বরং এক শক্তিশালী ভিত্তি—যার উপর দাঁড়িয়ে গড়ে তোলা যায় ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, নৈতিক রাষ্ট্রনীতি এবং মানবিক দর্শন।
আরও পড়ুনঃ কুড়িগ্রামের উলিপুরে সমাজসেবা কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা, জনতার হাতে যুবক আটক
*সূরা হুজুরাত, আয়াত-১৩ (বাংলা অনুবাদ):*
_“হে মানুষ, আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সে, যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।”(সূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩)!_
*১. আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতের তাৎপর্য:*
এই আয়াত সমাজে আইনের চোখে সকলকে সমান হিসেবে দেখার মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করে। এটি বলে দেয়, আইনের কাছে কারো সামাজিক অবস্থান, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কিংবা অর্থের ভিত্তিতে কোনো ভেদাভেদ চলবে না।
এই নীতিই আজকের আধুনিক আইনে “equality before law” বা আইনের দৃষ্টিতে সমতা নামে পরিচিত।
মুহাম্মাদ (ﷺ) প্রতিষ্ঠিত ইসলাম পূর্ব যুগে আরব সমাজে গোষ্ঠীগত প্রাধান্য, কাবিলাভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রবণতা ছিল। কুরআনের এই আয়াত সেই বর্ণবাদ ও শ্রেণিবৈষম্যের শিকড় কেটে দেয়।
আরও পড়ুনঃ দৈনিক বাংলার সংবাদের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি গুরুতর অসুস্থ।সবার কাছে দোয়া কামনা
*২. নীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার আলোকে ব্যাখ্যা:*
একটি রাষ্ট্রের নীতিমালার ভিত্তি হতে পারে এই আয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি: প্রশাসন, বিচার বিভাগ, ও সরকারি সেবায় যোগ্যতা, সততা ও তাকওয়া যেন পদোন্নতির মূল মানদণ্ড হয়।
সরকারী নিয়োগ, সুযোগ-সুবিধা, বা প্রতিনিধি নির্বাচনে সাধারণ জনগণের নৈতিক যোগ্যতা বিবেচনায় আনা উচিত; ধন-সম্পদ বা রাজনৈতিক সংযোগ নয়।
নীতিগতভাবে “meritocracy with moral character (নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন যোগ্যতাভিত্তিক নেতৃত্ব), এই আয়াতের প্রতিফলন।
*৩. নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দিক থেকে শিক্ষা:*
এই আয়াত নৈতিকতাকে কেন্দ্র করে একটি মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা দেয়: তাকওয়া মানে ‘আল্লাহর ভয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আদেশ-নিষেধ মান্য করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আত্মিক প্রতিরোধ, গোপনে-পূর্বে সৎ থাকা’।
আজকের সমাজে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও চরিত্রহীনতার উৎস হলো নৈতিকতাহীনতা ও আল্লাহভীতির অভাব। তাই এই আয়াত ব্যক্তি থেকে সমাজ পর্যন্ত সকল স্তরে নৈতিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভিত্তি।
আরও পড়ুনঃ কক্সবাজার সদর হাসপাতালে র্যাবের অভিযানে দালাল চক্রের চার সদস্য আটক, বিভিন্ন মেয়াদে সাজার নির্দেশ
*৪. দর্শনের আলোকে বিশ্লেষণ:*
এই আয়াত মানবতাবাদের একটি পরিশুদ্ধ রূপ উপস্থাপন করে। এটি বলে, মানুষকে চিনতে হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে—not racial, not ethnic or not social identity (কোনো জাতি, গোত্র বা সামাজিক অবস্থান নয়)।
এটি সাম্যবাদ (egalitarianism) যার মূল দর্শন হলো এমন একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক দর্শন যেখানে “সকল মানুষের মর্যাদা, অধিকার ও সুযোগ সমান, কিন্তু ঈমান ও আল্লাহভীতির ভিত্তিতে গড়া এক আলোকিত সাম্যবাদ।
এখানে “তাকওয়া” হচ্ছে আত্মিক উন্নয়নের শিখর, যেখানে মানুষ নিজেকে শুধরে নেয়, নিজেকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহির উপযুক্ত করে তোলে।
*৫. আজকের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা:*
যেখানে পদ-পদবি কিনে নেওয়া যায়, যেখানে ধর্মীয় লোকজনই দলীয় স্বার্থে বিভক্ত, যেখানে ধনীরা আইনের ঊর্ধ্বে, যেখানে বিচার ব্যর্থ হয় পরিচয়ের কাছে, সেখানে কুরআনের এই আয়াত এক বিপ্লবী আদর্শ: “মর্যাদা আল্লাহর কাছে তাকওয়ার ভিত্তিতে”। এটা একমাত্র মানদণ্ড, যা ভণ্ডামি, রাজনীতি, স্বার্থপরতা, আর মিথ্যাচারকে ঠেকাতে পারে।
আরও পড়ুনঃ মধুপুরে টাইফয়েড টিকাদান বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন সভা অনুষ্ঠিত
*উপসংহার:* সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় না কারো নাম, পদ, গোষ্ঠী বা সম্পদের ভিত্তিতে। বরং তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহভীতি, আত্মসংযম, সৎ চরিত্র এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান, এই হচ্ছে আসল মর্যাদা ও সম্মানের মানদণ্ড।
এই নীতি সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমরা একটি নৈতিক, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সমতাভিত্তিক বিশ্ব গড়তে পারব। ব্যক্তিজীবনে, রাষ্ট্রনীতিতে এবং বৈশ্বিক দর্শনে এই আয়াতের বার্তা প্রণিধানযোগ্য ও যুগোপযোগী।
_গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট (অতিরিক্ত সংযোজন):_ (ক). তাকওয়া যেমন সালাত, সিয়াম, যাকাত, দান, সাদকা, হজ্জের মধ্যে রয়েছে, তেমনি এটি ব্যক্তিত্ব, আচরণ, সিদ্ধান্ত ও কর্তব্যে প্রতিফলিত হয়। (খ). তাকওয়াবান ব্যক্তি সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে থাকেন, এমনকি সেটা নিজের স্বজনের বিরুদ্ধে হলেও।
(গ). এই আয়াত একটি মৌলিক মানবাধিকার ঘোষণা: “সম্মান ও মর্যাদা সবার প্রাপ্য, কিন্তু আসল মর্যাদা তাকওয়ার দ্বারা নির্ধারিত”। (ঘ). এই আয়াত আন্তর্জাতিক নীতিতে “inclusivity – অন্তর্ভুক্তিমূলক” ও “non-discrimination – বৈষম্যহীন” এর সমার্থক।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ০৭-০৮-২৫)