জাহেদুল ইসলাম আল রায়ানঃ
ঢাকার আকাশে জাতিসংঘের মিশনের নাম উচ্চারিত হতেই বাতাস যেন অন্য রঙে ভিজে উঠেছে। নীল পতাকার মৃদু দোলার ভেতর অচেনা এক স্রোত বইছে। শান্তির প্রতিশ্রুতির আড়ালে সেখানে আছে এক অদৃশ্য চলন, যা ইতিহাসের অন্ধকার পাতাগুলো উল্টে দেয়। যে দরজা আজ খুলছে, সেই দরজা একদিকে আশার আলো ছড়ালেও অন্যদিকে লুকিয়ে রাখে অজানা আঁধারের ছায়া।
জাতিসংঘের মিশনের পথে হাঁটা প্রতিটি দেশ জানে, এই আগমন কখনো কেবল সাদা কাগজের প্রতিশ্রুতি নয়। বসনিয়ার কুয়াশা, রুয়ান্ডার শোকভেজা মাঠ, কঙ্গোর লাল ধুলো—সবই সাক্ষী। শান্তির পতাকা সেখানে বয়ে এনেছে শুধু সুর নয়, এনেছে অদৃশ্য শৃঙ্খল।
আরও পড়ুনঃ বাবার ওপর অভিমান করে নুসরাত (১৪) নামে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে
চোখে না দেখা সেই বাঁধন ধীরে ধীরে দেশের নিজস্ব সুরকে ভেঙে দিয়েছে, তার সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা মুছে দিয়েছে। বাংলাদেশ আজ সেই একই করিডরের মুখে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই ভবিষ্যতের ইতিহাস গড়বে অথবা মুছে দেবে।
এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকার ছায়া যেন আরও গাঢ়। জাতিসংঘের পতাকা যখন নামে, বড় শক্তির স্বর সেখানে নিঃশব্দে গেঁথে থাকে। আর আমেরিকা প্রমাণ করেছে, আধিপত্যের জন্য তার সবসময় সৈন্য লাগে না; অনেক সময় লাগে কেবল একটি সুর, একটি প্রতীক।
তাদের জাতীয় সংগীতের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বর্ণবৈষম্যের ক্ষত ইতিহাসের কালো আয়না হয়ে দাঁড়ায়। সেই সংস্কৃতি যদি শান্তির নামে আমাদের ভেতরে প্রবেশ করে, তা শুধু কূটনীতির নয়—তা হবে আত্মার গভীরে ঢুকে পড়া এক নীরব সাম্রাজ্য। তখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের নিজস্ব সুর কি আর নিজের থাকবে, নাকি তা হয়ে যাবে অন্যের হাতে লেখা অনুবাদ?
আরও পড়ুনঃ শেষ ট্রেনের ঠিকানা তারিকুল আমিন
বাংলাদেশের মাটির ইতিহাস রক্তের নয়, সৃষ্টির। তার আত্মা যুদ্ধ নয়, জীবনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক পতাকার ছায়া ঘনিয়ে আসে, তখন প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে মিশে যায় অচেনা এক শীতলতা।
আজকের এই সিদ্ধান্ত শুধু রাজনীতির টেবিলের নয়; এটি ভবিষ্যতের জাতীয় সুরের ভাষা ঠিক করবে। যদি সত্যিকারের শান্তি আসে, তা হবে উৎসবের মতো। কিন্তু যদি সেই শান্তির ভেতর ঢুকে পড়ে নিঃশব্দ এক আধিপত্যের সুর, তবে একদিন হয়তো আমরা নিজের গান গাইব, কিন্তু তাতে নিজের সত্তার প্রতিধ্বনি থাকবে না।
ঢাকার আকাশের নিচে আজ সেই মুহূর্ত দাঁড়িয়ে আছে। নীল পতাকার ছায়া লম্বা হচ্ছে, তার নীরব চলন শহরের প্রতিটি ইটের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। ইতিহাস অপেক্ষা করছে—এই পদক্ষেপ কি বাংলাদেশের আত্মাকে রক্ষা করবে, নাকি ধীরে ধীরে তাকে অন্যের ছন্দে বেঁধে দেবে।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর