এস এম সেলিম উল্লাহ্ঃ
মাইজভাণ্ডারী তরিকতের একজন নির্লোভ চিরকুমার সুফিসাধক হযরত শাহ্ সুফি “মৌলভী তোফাজ্জল আহমদ ফকির” মাইজভাণ্ডারী (রহঃ)।
ফটিকছড়ি উপজেলার জাফতনগর ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামের এক নিবেদিতপ্রাণ আলেম-এ দ্বীন, সাধক ও মাইজভাণ্ডারী তরিকতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন হযরত শাহ্ সুফি তোফাজ্জল আহমদ ফকির (রহঃ)।
তিনি ঐ গ্রামেরই একজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব হযরত গাউসুল আজম বিল বিরাসাত শাহ্ সুফি সৈয়দ গোলাম রাহমান বাবা ভান্ডারী(ক)’র পবিত্র সহবত প্রাপ্ত ভক্ত হযরত মৌলভী শাহ সুফি আবু আহমদ প্রকাশ “জীবনী ফকির” (র)’র কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন।
এই মহান সাধকের আলোচনার আগে কিঞ্চিত তাঁর পিত্র পরিচয়ের স্মৃতিচারণ প্রয়োজন মনে করি।
হযরত “জীবনী ফকির” (র)’র পরিচিতি ও কৃতিত্ব বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরের সকল মাজার-দরগাহ ভক্তকুল ও মাইজভান্ডারী পরিমণ্ডলে বিস্তৃত। তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত অখন্ড ভারতবর্ষের সুবিখ্যাত সুফিসাধক হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ মহিউদ্দিন চিশতী আজমেরী (রাদি)’র দরবারে পাকে দীর্ঘ ২২ বছর অবস্থানের পরবর্তী আমৃত্যু আজমীর শরীফ আসা-যাওয়া করতেন এবং বাংলাদেশের আউলিয়া প্রেমিকগণকে হযরত খাজা বাবা চিশতী আজমিরী (ক),
বাংলাদেশে প্রবর্তিত একমাত্র মাইজভান্ডারী তরিকার প্রবর্তক হুজুর গাউসুল আজম হযরত শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী(ক), বাবা ভান্ডারী (র) সহ বিভিন্ন আওলিয়ায়ে কেরাম গনের জীবনী আলোচনা করে শুনাতেন। যার প্রেক্ষিতে তার প্রকৃত নাম হযরত আবু আহমদ হলেও লোকসমাজে তিনি “জীবনী ফকির” নামেই বিশেষ ভাবে সুপরিচিত।
পবিত্র আজমীর শরীফ থেকে খেদমতের শেষ বিদায়ের পর বাংলাদেশে নিজ গ্রামে ১৯৩৭ সনে বাংলা একুশে পৌষ খাজা বাবার বাৎসরিক ওরস প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে কোডের পারস্থ নিজস্ব জায়গায় ছোট্ট পরিসরে খাজা বাবার একটি আস্তানা গড়ে তোলেন। জীবনের সুদীর্ঘকাল তরিকতের খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে ১৯৮১ সনে ওই আস্তানার পাশেই চিরনিদ্রায় সমাহিত হন।
আরও পড়ুনঃ জরুরী মানববন্ধন
হযরত জীবনী ফকির (র)’র আদরের কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন এই হযরত মৌলভী তোফাজ্জল আহমদ ফকির রাহমাতুল্লাহি আলাই। শৈশব থেকেই তিনি স্বীয় বুজুর্গ পিতার হাত ধরে মাইজভান্ডারী তরিকরতে সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। খেলাধুলা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা পার্থিব জীবন কখনো তাঁকে আকৃষ্ট করেনি।
সবসময় পিতার সঙ্গে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন ধ্যান, জিকির, মাজারভক্তি আর আত্মশুদ্ধির সাধনায়। পিতার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনিও ছিলেন একান্ত সত্যিকারের সংযমী আত্মত্যাগী নিঃস্বার্থ সুফিসাধক ও মাইজভান্ডারী তরিকতে “ফকির” নামে পরিচিত। এই “ফকির” শব্দটি তরিকত অঙ্গনে এক মহা তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। চাইলেই যে কেহ এই শব্দটি নামের উপাধি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না।
তিনি কোর্টের পাড়স্ত সর্ব পরিচিত সেই ছোট্ট এক টিনের ঘরে নিরবে-নিভৃতে সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। পিতার মতো তিনিও মাইজভান্ডারী তরিকরতের ও আজমীর শরীফের প্রচারে নিজের জীবন উৎসর্গ করে শেষ বয়সে জাহানপুরে পিতার রেখে যাওয়া সেই প্রতিষ্ঠান এবং পবিত্র সমাধিস্থল পবিত্র “খাজা বাবার আস্তানা”য় তাঁর সাধনার নীড় করে নেন। সেখানেই ধ্যান-ভজন, তাফাক্কুর আর খোদাভক্তির মধ্যে কাটিয়ে দিতেন দিন-রাত। তাঁর শরীরের দুর্বলতা বা অসুস্থতা কখনও তাঁকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখতে পারেনি।
তাঁর জীবনের বড় দিক ছিল বিনয়, ভক্তি আর দয়াশীলতা। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। দূরদূরান্ত থেকে এসে বহু মানুষ তাঁর কাছে দুঃখের কথা শেয়ার করত, সুস্থতার দোয়া চাইত। তিনি সাধ্যমত সকলের পাশে দাঁড়াতেন। তাঁর বাড়ি ছিল তরিকতের দরবার, যেখানে মাইজভাণ্ডারী বৈঠক বসত, আশেকে রাসূলদের মিলন হতো। প্রতিবছর ২১ পৌষ পিতার স্মৃতি বিজড়িত অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে হয় বিশাল আয়োজন এবং হাজার মানুষের সমাগম।
অগণিত ফকির-দরবেশ, নারী-পুরুষ, ভক্ত তাঁর সংস্পর্শে এসে আল্লাহর প্রেম ও নৈকট্য লাভ করতেন। তিনি কখনো অহংকারী ছিলেন না। সাদামাটা জীবনযাপন আর অশেষ ধৈর্য-সহনশীলতা ছিল তাঁর বিশেষ গুণ। তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ ও নিঃশব্দ এক সাধক, যাঁর বিদায়ে মুসলিম, হিন্দু, বুদ্ধ সহ এলাকাজুড়ে সর্বস্তরের জনগণের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
আরও পড়ুনঃ কোস্ট গার্ডের ৩০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ
নির্লোভ, চিরকুমার এই মহা সাধকের কাছে কখনো বর্ণবাদীতা পরিলক্ষিত হয়নি। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে রব্বুল আলামিনের সৃষ্টিকুল কে তিনি একই তৌহিদের সূতাই বন্ধন করতে পেরেছেন। তিনি সাধনার এমন উচ্চ মার্গে পৌঁছেছিলেন যে ওফাত পরবর্তী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এখনো ভক্তকূল তাঁর সমাধি জিয়ারতে ছুটে আসেন।
সামাজিক উন্নয়নে তার অবদান অনস্বীকার্য। আজো তাঁর স্মৃতি এলাকাবাসীর হৃদয়ে অম্লান। তাঁর নিঃস্বার্থ সাধনা, মানবিকতা ও তরিকতের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে অমর করে রেখেছে। উল্লেখ্য যে তিনি ৬ আগস্ট ২০২৩ ইংরেজি,২২ শ্রাবণ ১৪৩০ (বাংলা) মোতাবেক,১৮ মুহাররম ১৪৪৫ (হিজরি) সনে ইন্তেকাল করেছিলেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।