ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*ওহী ও সুন্নাহ: ইসলামের ভিত্তি, সীমারেখা এবং প্রমাণের আলোকে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক*
একজন দ্বীনি ভাই লিখেছেন: “আস-সালামু আয়লাইকুম মুসা ভাই, আপনার এই আলোচনায় ওহী ভিত্তিক ইসলামের সংজ্ঞা সম্ভবত অতি সরলীকরণ দোষে দুষ্ট। ওহী ও সুন্নাহ কিন্তু পৃথক বিষয়।
ওহী কেবল মাত্র জিবরিলের মাধ্যমে প্ররিত মহান রবের কালাম বা কথা যা অনন্ত বা যার সৃষ্টি ও ধ্বংস নাই, যার সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন।
সুন্নাহ (যদিও ওহীকে ব্যাখ্যা করেছে) কিন্তু ওহী না। সুন্নাহকে ওহী মর্যাদা দেয়াটা এক ধরনের শির্ক হতে পারে। কারন ওহি মহান রবের একটি গুণবাচক বৈশিষ্ট্য”।
আরও পড়ুনঃ লামায় যৌথ অভিযানে বালুখেকু আব্দু শুক্কুর ও আলতাজ মিয়া গ্রেফতার, পৃথক কারাদণ্ড
_প্রিয় দ্বীনি ভাই: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইসলামের মূল ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই দলিল ও প্রমাণের আলোকে কিছু আলোচনা পেশ করছি।_
*১. কুরআন আল্লাহর বাণী (وحي متلو):* কুরআন নিঃসন্দেহে আল্লাহর বাণী, কালাম, যা জিবরীল (আ.)-এর মাধ্যমে মুহাম্মদ (ﷺ)-এর উপর নাযিল হয়েছে। যেমন: “নিশ্চয়ই এটি জগতসমূহের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। এটি রূহুল আমীন (জিবরীল) নিয়ে এসেছে, তোমার হৃদয়ে, যেন তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও”। (সূরা আশ শোআরা: ২৬:১৯২-১৯৪)।
এটি ওহী মাতলু *(وحي متلو)*, অর্থাৎ শব্দ ও অর্থ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে, যা সালাতে পাঠ করা হয়।
*২. কুরআনের ব্যাখ্যা আল্লাহ নিজেই করেছেন (৭৫:১৭-১৯):* কুরআনের ব্যাখ্যা, বর্ণনা এবং বিশ্লেষণও আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই এর (কুরআনের) সংরক্ষণ এবং পাঠের দায়িত্ব আমাদের। অতএব যখন আমরা একে পাঠ করি, তখন তুমি তার অনুসরণ কর। অতঃপর এর ব্যাখ্যা আমাদের দায়িত্ব”। (সূরা আল-কিয়ামাহ, ৭৫:১৭-১৯)।
এটি স্পষ্ট প্রমাণ যে, কুরআনের ব্যাখ্যাও ওহীর অংশ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্দেশিত। মূলত, জিবরীল (আ.) নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর কাছে ব্যাখ্যা, বর্ণনা, বিশ্লেষণও পৌঁছে দিয়েছেন।
*৩. জিবরীল (আ.) ব্যাখ্যা করেছেন মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নিকট:* জিবরীল (আ.) কেবল কুরআন নাযিল করেননি, বরং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন, বিখ্যাত হাদীসে জিবরীল, যেখানে ইসলাম, ঈমান, ইহসান প্রভৃতি বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এসব ব্যাখ্যা সরাসরি ওহীর অন্তর্ভুক্ত (সহীহ মুসলিম:১)।
*৪. মুহাম্মদ (ﷺ) কুরআন ব্যাখ্যা করেছেন সাহাবীদের নিকট (১৬:৪৪; ১৬:৬৪):* কুরআন স্পষ্টভাবে বলছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অন্যতম দায়িত্ব হলো কুরআন তিলাওয়াত করা এবং মানুষের কাছে তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা। যেমন: “আর আমরা তোমার প্রতি এই জিকর (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষের কাছে তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করো, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে”। (সূরা নাহল, ১৬:৪৪)।
আরও পড়ুনঃ জুলাই ঘোষণা ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাবনা
আরও বলা হয়েছে: “আমরা তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি তাদের কাছে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করো সেইসব বিষয়ে, যাতে তারা মতভেদ করেছে”। (সূরা নাহল, ১৬:৬৪)।
এখান থেকে স্পষ্ট হয়, নবীর (ﷺ) ব্যাখ্যা ওহী গাইরু মতলু *(وحي غير متلو)*, অর্থাৎ এটি আল্লাহর নির্দেশে, আল্লাহর পক্ষ থেকে।
*৫. সুন্নাহও ওহী (وحي غير متلو):* রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের খেয়াল থেকে কিছু বলেননি। আল্লাহ বলেন: “তিনি (নবী) নিজের খেয়াল থেকে কিছু বলেন না। এটি তো ওহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়”। (সূরা আন-নাজম, ৫৩:৩-৪)।
অর্থাৎ, সুন্নাহও ওহীর অংশ, যদিও কুরআনের মতো নয়। শব্দ নবীর, কিন্তু অর্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে। এটি ফিকহের পরিভাষায় ওহী গাইরু মতলু *(وحي غير متلو)*।
*৬. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দায়িত্ব:* কুরআন স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দায়িত্ব শুধু আয়াত তিলাওয়াত করা নয়, বরং কুরআনের ব্যাখ্যা, শিক্ষা এবং চরিত্র গঠনের কাজও তিনি করেছেন। আল্লাহ বলেন: “তিনিই উম্মীদের মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূল রূপে, যিনি তাদের কাছে তিলাওয়াত করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাহ; অথচ তারা পূর্বে ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে”। (সূরা আল-জুমু’আ, ৬২:২)।
একই দায়িত্বের উল্লেখ এসেছে আয়াতসমূহ ২:১২৯; ২:১৫১; ৩:১৬৪ তেও, যেখানে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানুষের কাছে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদের পবিত্র করেন, এবং কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন।
এসব আয়াত প্রমাণ করে যে, কুরআনের তিলাওয়াতের পাশাপাশি এর বয়ান, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ এবং বাস্তব প্রয়োগও নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত, যা ওহী গাইরু মতলু, অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত জ্ঞান। সুতরাং, সুন্নাহ ওহীর অন্তর্ভুক্ত; সুন্নাহ ইসলামের মূল উৎসেরই অংশ।
_সারসংক্ষেপ:_ কুরআনের শব্দ ও অর্থ দুটোই আল্লাহর পক্ষ থেকে, যা সালাতে তিলাওয়াত করা হয়। নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) কর্তৃক কুরআনের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ এবং বাস্তব প্রয়োগ হলো আল্লাহর নির্দেশে, যদিও শব্দ নবীর, অর্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে। এর প্রমাণ সুন্নাহ-হাদীস, যা সালাতেও পাঠ করা হয়। যেমন: “উদাহরণস্বরূপ, সালাতের শুরুতে ‘আল্লাহু আকবার’, সানা; রুকু-সাজদায় তাসবীহ; বৈঠকে তাশাহুদ, দুরুদ, দো‘আ, সালাম; বিতরে কুনুত ও দো’আ—এসব সবই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ, যা তিনি জিবরীল (আ.)-এর মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন।”
উল্লেখযোগ্য যে, জিবরীল (আ.)-এর ইমামতিতে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) দুইদিনে মোট ১০ রাকাআত সালাত আদায় করেছেন এবং সালাতের সকল কিছু তিনি জিবরীল (আ.)-এর নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন, সেই হিসেবে পুরো সালাতই ওহী প্রাপ্ত। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৬১০)।
সুতরাং, সুন্নাহকে ওহীর মর্যাদা দেওয়া শির্ক নয়, বরং আল্লাহর বাণীর ব্যাখ্যা ও বাস্তব প্রয়োগ। ইসলামের উৎস দুইটি—কুরআন এবং সহীহ সুন্নাহ—দুটিই ওহীর অন্তর্ভুক্ত, যদিও তাদের গুরুত্ব ও স্তর পৃথক।
*৭. উপসংহার:* ওহী এবং সুন্নাহ দুটি পৃথক পরিভাষা হলেও উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং ইসলামের মূল উৎস। কুরআন নিজেই প্রমাণ করছে যে, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও আল্লাহর নির্দেশে নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর উপর নাযিলকৃত। তাই সুন্নাহকে ওহী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শির্ক নয়, বরং ইসলামের মূল নীতি ও ফিকহের অংশ। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ এবং কুরআন ও সুন্নাহর উপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ। আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ১১-০৭-২৫)