ওয়াস-সালাম,
ডা. এম. জি. মোস্তফা মূসাঃ
_ভূমিকা:_ আমাদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনের অধিকাংশ সংকটই সৃষ্টি হয়—অসহনশীলতা, প্রতিশোধপরায়ণতা, মন্দের বদলে আরও মন্দ ব্যবহারের কারণে। অথচ কুরআন বারবার মানুষকে ক্ষমা, সদুপদেশ ও মূর্খতাকে উপেক্ষার মাধ্যমে উত্তম চরিত্র গঠনের দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
সূরা আ’রাফের ১৯৯ নম্বর আয়াতটি এক বৈপ্লবিক নৈতিক ও আচরণগত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, যা শুধু ব্যক্তিজীবনের জন্য নয়—সমাজ, নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও একটি পরিপূর্ণ নির্দেশনা।
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে যেমন মানুষের সীমাবদ্ধতা অনুধাবনের শিক্ষা দিয়েছেন, তেমনি চরম রূঢ়তা ও মূর্খতার প্রতিক্রিয়ায় নেমে না গিয়ে সংযম ও প্রজ্ঞাবান আচরণের আদেশ দিয়েছেন।
এই আয়াত ও তার তাফসীর বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি, ইসলামের নৈতিকতা কেবল ধর্মীয় আচার নয়—বরং মানবিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল স্তরে একটি পরিশীলিত নীতিবোধের আহ্বান।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—এই আয়াতের আইন, নীতি, নৈতিকতা, চরিত্র এবং আচরণগত শিক্ষা ও হিকমাহসমূহ সম্পর্কে।
*সূরা আ’রাফ, আয়াত ১৯৯:*
*﴿خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ﴾*
“মানুষের (চরিত্র ও কর্মের) উৎকৃষ্ট অংশ গ্রহণ করুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলুন।”
*১. আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আলোকে আয়াতটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ:*
এই আয়াত একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক ও নৈতিক আচরণনীতি নির্ধারণ করেছে—যা আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ ও নেতৃত্বনীতির জন্য একটি আদর্শ সংবিধান।
_*১.১ আইনগত দিক থেকে:*_
_(ক). ক্ষমা ও সহনশীলতা (العفو):_ ন্যায়বিচারের পাশাপাশি ইসলামী আইন ক্ষমাকে উৎসাহিত করে। ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিশোধ নয়, বরং বিচারিক পন্থা ও ক্ষমার সুযোগ রাখা—এটাই ইসলামের ন্যায়ব্যবস্থা।
_(খ). সৎকাজের আদেশ (العرف):_ নীতিগতভাবে সমাজে যেসব কাজকে ভালো বলা হয়, সেসবের প্রতি উৎসাহ প্রদান আইন প্রয়োগের নীতিগত কাঠামো গড়ে তোলে। ইসলাম শুধু শাস্তিমূলক নয়, বরং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও পজিটিভ এনগেজমেন্টেও বিশ্বাসী।
_(গ). মূর্খদের উপেক্ষা (الْجَاهِلِينَ):_ রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে যারা অজ্ঞতাবশত অপমান বা উসকানিমূলক আচরণ করে, তাদের প্রতি আবেগ নয় বরং যুক্তিবাদিতা ও ধৈর্যের নীতি অনুসরণ জরুরি।
_*১.২ নীতিনৈতিকতার দিক থেকে:*_
এই আয়াত নৈতিক দৃঢ়তা, ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা, সদ্ব্যবহার, এবং অন্তর্জ্ঞান– এসবের সমন্বয়ে গঠিত এক উচ্চতম চারিত্রিক গুণাবলি গড়ে তুলতে নির্দেশ দেয়।
সমাজ, রাজনীতি বা প্রশাসনে যারা নেতৃত্ব দেন, তাদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা—ক্ষমতার অপব্যবহার নয়, বরং নম্রতা ও ন্যায়বোধ বজায় রাখা।
*২. আয়াত থেকে শিক্ষণীয় আচরণ (Behavior), চরিত্র (Character) এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধ (Ethics & Morals):*
_২.১ আচরণ (Behavior):_ সহজাত মানবিক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা বুঝে মানুষের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করা। জাহেল বা মূর্খদের প্রতি রূঢ় না হয়ে সহনশীলতা ও দূরত্ব বজায় রাখা।
_২.২ চরিত্র (Character):_ নিজস্ব চারিত্রিক দৃঢ়তা বজায় রেখে অন্যদের প্রতি সদাচরণ। অভিজাত মনোভাব পরিহার করে সাধারণ মানুষের অবস্থান বুঝে চলা।
_২.৩ নৈতিকতা ও মূল্যবোধ (Ethics & Morals):_ ইনসাফ, সহনশীলতা, মানবিকতা ও পরিমিতিবোধের সামগ্রিক প্রকাশ। সদুপদেশ ও কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি—যা ইসলামি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থারও অংশ।
আরও পড়ুনঃ শেরপুর জেলা পুলিশের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত
*৩. শিক্ষা, উপদেশ ও হিকমাহ (হিকমাহপূর্ণ জ্ঞান):*
_৩.১ ক্ষমা মানুষকে বড় করে তোলে:_ ক্ষমা শুধু দুর্বলদের নয়, বরং শক্তিমানদের গুণ, যারা প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েও তা পরিহার করে।
_৩.২ আদর্শিক নেতৃত্বের গুণ:_ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবীদের জীবনাদর্শে এই নীতির বাস্তব রূপ বিদ্যমান। বিশেষত হাদীসে বর্ণিত উমার রা. এর আচরণ ছিল কুরআনের প্রতি নিষ্ঠা ও চরিত্রের সংযমের এক উত্তম দৃষ্টান্ত।
_৩.৩ শ্রেণি ও সামর্থ্যভেদে দায়িত্ব বোঝা:_ সব মানুষের একমাত্র মানদণ্ডে বিচার নয়; বরং যার যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে, সেই অনুযায়ী তার কাছ থেকে দায়িত্ব আশা করা—এটাই সুবিচার।
_৩.৪ সদাচরণের মাধ্যমে অসদাচরণকে প্রতিহত করা:_ ইসলাম ‘উইন উইথ গুডনেস’ নীতি শেখায়—মন্দের বদলে ভালো ব্যবহার, যে অনেক সময় অন্যকে সংশোধনের পথ দেখায়।
তুমি মানুষকে দা’ওয়াত দাও তোমার রবের পথে হিকমাহ ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক কর উত্তম পন্থায় (১৬:১২৫)।
_৩.৫ জাহেলদের প্রতি প্রতিক্রিয়া নয়, দায়িত্বপূর্ণ উদাসীনতা:_ প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ নয়; বরং বিবেক, যুক্তি ও ভদ্রতা বজায় রেখে নিজেদের উচ্চতর মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
*৪. উপসংহার:* সূরা আ’রাফ, আয়াত ১৯৯ এমন একটি নৈতিক ও আচরণগত নির্দেশনা প্রদান করে যা ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রজীবন পর্যন্ত সকল স্তরে প্রযোজ্য। একজন প্রকৃত মু’মিন, সমাজপতি, নেতা বা শিক্ষক এই তিনটি গুণ ধারণ করলেই সমাজে শৃঙ্খলা, ন্যায় এবং মানবিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে: ক্ষমাশীলতা (العفو), সদুপদেশ (العرف), এবং মূর্খদের অবজ্ঞা (الإعراض).
এই আয়াত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর চারিত্রিক মহানতা ও উত্তম নৈতিকতাকে প্রতিফলিত করে। আমাদের সবার উচিত—এই আয়াতের নির্দেশনাগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করা, অন্যদের জন্য আদর্শ হয়ে উঠা এবং ইসলামের সৌন্দর্যকে আচরণে প্রকাশ করা।
“Character is not what we preach, it’s what we practice silently.” আল্লাহ্ যেন আমাদেরকে এই আয়াতের শিক্ষা অনুযায়ী জীবনে চলার তাওফিক দেন—আমিন।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন* I (মূসা: ২২-০৬-২৫)