ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
_ভূমিকা:_ মানবসভ্যতার ইতিহাসে আল্লাহ তাআলার ওহী সর্বদা একটি কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে আছে। নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের ও সমাজকে পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু সর্বশেষ ওহী ‘কুরআনুল কারীম’ হলো এমন এক দিকনির্দেশনা, যা কেবল একটি আইনগত গ্রন্থ নয়, বরং মানবতার জন্য অন্ধকারে আলো-নূর।
সূরা আশ-শূরা’র ৫২ নং আয়াতে ওহীর প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ও নবী করীম (ﷺ)-এর উপর আরোপিত দায়িত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, কুরআন হলো রূহ এবং নূর, যা দ্বারা তিনি যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন, আর নবী করীম (ﷺ)-এর দায়িত্ব কেবল সরল পথ প্রদর্শন করা।
*১. আয়াতের মূল শব্দ বিশ্লেষণ:*
_(ক). ওহী (*وَحْي*):_ আল্লাহর পক্ষ থেকে গোপন ও অদৃশ্য মাধ্যমে বান্দাকে বার্তা পৌঁছে দেওয়া। কুরআনই সর্বোচ্চ স্তরের ওহী, যা জিবরাঈল (আ.) নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ক্বলবে-অন্তরে স্থাপন করেছেন।
_(খ). রূহ (*رُوحًا*):_ এখানে রূহ বলতে কুরআনকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন দেহ নাফস ছাড়া মৃত, তেমনি নাফস কুরআন ছাড়া মৃত, কুরআন নাফসকে ঈমানের শক্তিতে শক্তিশালী করে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন: “রূহ অর্থাৎ এখানে কুরআন, যা মানুষের নাফসে নূরের সঞ্চার করে, ঈমানের নূরে নূরান্বিত করে।”
_(গ). আমর (*أمر*):_ আল্লাহর নির্দেশ বা সৃষ্টিশীল হুকুম।কুরআন কোনো মানব-রচিত বই নয়, বরং সরাসরি আল্লাহর আদেশ, হুকুম।
আরও পড়ুনঃ বগুড়া গাবতলী থানা পুলিশর বিশেষ অভিযানে সাজাপ্রাপ্ত আসামিসহ ০৪ জন গ্রেপ্তার
*২. কিতাব ও ঈমান প্রসঙ্গে নবী কারীম (ﷺ)-এর অবস্থা:*
আয়াতটি নবী করীম (ﷺ)-কে উদ্দেশ্য করে বলা। তাঁর পূর্বে কোনো কিতাব তিনি পড়েননি, লিখেননি (সূরা আনকাবুত ২৯:৪৮)। কিতাব ও ঈমানের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান তিনি ওহী প্রাপ্তির মাধ্যমে জেনেছেন। অর্থাৎ মানবতার জন্য নতুন জ্ঞানের উন্মোচন হলো কুরআনের মাধ্যমে।
*৩. কুরআনকে নূর বলা কেন:*
*“وَلَـٰكِن جَعَلْنَـٰهُ نُورًۭا”*
অর্থাৎ আল্লাহ কুরআনকে নূর করেছেন। নূর হলো আলোকপ্রদীপ স্বরূপ, যা জাহিলিয়াতের অন্ধকার দূর করে; দূর করে শিরক, কুফুর, বিদ’আত, গোত্র অহমিকা ইত্যাদি, যা হলো অন্ধকার স্বরূপ। কুরআন জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে মানবতাকে মুক্ত করে। হিদায়াত আল্লাহর হাতে, আর তিনি যাকে ইচ্ছা এই নূরের আলোতে হিদায়াতের পথ দেখান।
*৪. নবী কারীম (ﷺ)-এর দায়িত্ব ও সীমারেখা:*
নবী কারীম (ﷺ)-এর দায়িত্ব কেবল সরল পথ প্রদর্শন করা (*إِنَّكَ لَتَهْدِىٓ إِلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ*)। প্রকৃত হিদায়াত বা অন্তরের পরিবর্তন আল্লাহর হাতে। এভাবে নবী করীম (ﷺ)-এর দায়িত্ব হলো দাওয়াত, ব্যাখ্যা ও বাস্তব দিকনির্দেশনা দেওয়া।
*৫. সদৃশ্য আয়াতসমূহ:*
সূরা নিসা, (৪:১৭৪): “মানুষের কাছে এসেছে তাদের রবের পক্ষ থেকে প্রমাণ এবং আমি পাঠিয়েছি স্পষ্ট নূর।”
সূরা ইবরাহীম, (১৪:১): “এ কিতাব আমি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আন।”
সূরা ইউনুস, (১০:৫৭): “তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ, অন্তরের রোগের আরোগ্য, হিদায়াত ও রহমত।”
*৬. সদৃশ্য হাদীসসমূহ:*
রাসূল ﷺ বলেন: “কুরআন আল্লাহর নূর; যে এটিকে আঁকড়ে ধরে, সে সঠিক পথ পায়”। (মুসলিম, তিরমিজি)! “কুরআন আল্লাহর মজবুত দড়ি, আলোকিত নূর”। (ইবনে হিব্বান)
আরও পড়ুনঃ “তালের পিঠা”- রাহেলা আক্তার
*৭. আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে:*
_(ক). আইন (Legal Dimension):_ কুরআনকে রূহ ও নূর হিসেবে স্বীকার করা মানে এটিকে মানবজাতির চূড়ান্ত আইন ও শরীয়তের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা। মানব-প্রণীত আইন সীমিত ও ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু কুরআনের বিধান সর্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ।
_(খ). নীতি (Policy/Principle):_ কুরআন সমাজের মৌল নীতি নির্ধারণ করে: ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা, সমতা। আল্লাহর ওহীই হলো সেই নীতি, যার বাইরে অন্য কোনো নীতি মানবতার পূর্ণ কল্যাণ আনতে সক্ষম নয়।
_(গ). নৈতিকতা (Ethics):_ কুরআন মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতা গঠনের মূল ভিত্তি। সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধৈর্য, দয়া—এসব নৈতিক মূল্য কুরআনের শিক্ষা ছাড়া পূর্ণ হয় না।
_(ঘ). মূল্যবোধ (Values);_ কুরআনকে নূর বলা হয়েছে কারণ এটি মানবতার মৌল মূল্যবোধগুলোকে (মানব মর্যাদা, স্বাধীনতা, অধিকার, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সংহতি, ন্যায়বিচার) সংহত করে এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।
_ঙ. দর্শন (Philosophy):_ ‘রূহ’ ও ‘নূর’ প্রতীকগুলো জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) ও অস্তিত্বতত্ত্ব (Existential Philosophy)-এর গভীর অর্থ বহন করে। দেহ যেমন নাফস ছাড়া মৃত, তেমনি জ্ঞান ও সভ্যতা কুরআনের আলো ছাড়া অন্ধকারে নিমজ্জিত। এভাবেই কুরআন মানুষের আত্মিক ও জ্ঞানচর্চার চূড়ান্ত ভিত্তি।
*৮. শিক্ষা ও হিকমাহ:*
(ক). কুরআন হলো নাফস (আত্মা)-এর জন্য নূর, হিদায়াত ও সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা।
(খ). নবী করীম (ﷺ)-এর দায়িত্ব হলো হিদায়াতের দাওয়াত দেওয়া; হিদায়াত আল্লাহর হাতে।
(গ). কুরআন ছাড়া মানুষ নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও জ্ঞানে অপূর্ণ। কুরআন হলো রূহ ও নূর।
(ঘ). আইনগতভাবে কুরআন মানবতার জন্য পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত।
(ঙ). দর্শনের দিক থেকে কুরআন মানুষের অস্তিত্বের অর্থ ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে।
আরও পড়ুনঃ শরৎ এলো ফুলের ডালা নিয়ে নার্গিস আক্তার
*৯. উপসংহার:* সূরা আশ-শূরা’র ৫২ নং আয়াত প্রমাণ করে যে কুরআন মানবজাতির জন্য একটি অনন্য দিকনির্দেশনা। এটি ওহী, যা রূহের মতো নাফসকে প্রাণবন্ত করে এবং নূরের মতো অন্ধকার দূর করে। নবী কারীম (ﷺ) নিজে কোনো কিতাব জানতেন না, ঈমানের পূর্ণ রূপও জানতেন না; আল্লাহই তাঁকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন, ঈমান শিক্ষা দিয়েছেন, যা আল্লাহর বান্দাদের জন্য হিদায়াত।
এই আয়াত মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে সত্যিকারের আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দর্শন কেবল কুরআনের আলোতেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সুতরাং আল্লাহর নূরের দাওয়াত গ্রহণ করা ছাড়া মানুষের প্রকৃত মুক্তি ও হিদায়েত নেই।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ২৬-০৮-২৫)