*”সূরা আল-মায়েদা: একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নীতিমালা”*
*১. সূরা মায়েদার ভূমিকা:* সূরা আল-মায়েদা (সূরা নম্বর ৫) মদীনায় অবতীর্ণ একটি দীর্ঘ সূরা, যাতে মোট ১২০টি আয়াত রয়েছে। এটি ইসলামী শরীয়তের পরিপূর্ণতা, বিধান ও নৈতিক দিকনির্দেশনার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
এ সূরায় মুসলিম উম্মাহর জন্য হালাল-হারামের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, ধর্মীয় দায়িত্বশীলতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ঈসা (আ.)-এর প্রসঙ্গসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এবং বিধানগত বহু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত এই সূরায় স্থান পেয়েছে। এটি এমন এক সূরা, যার মাধ্যমে ইসলামি জীবনব্যবস্থার পরিপূর্ণ কাঠামো চিত্রিত হয়েছে।
*২. সূরা মায়েদায় বর্ণিত ঈমান ও আক্বিদা:* সূরা মায়েদায় ঈমান ও আক্বিদার দিক থেকে তাওহীদ (আল্লাহর একত্ব), রিসালাত (নবুয়ত), এবং আখিরাত (পরকাল)-এর প্রতি বিশ্বাস সুদৃঢ় করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ঈসা (আ.) এবং তাঁর অনুসারীদের প্রসঙ্গ তুলে ধরে খ্রিস্টানদের বিভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে, এবং স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ একক স্রষ্টা ও রব্ব, তিনি কাউকে সন্তান করেন না, এবং ঈসা (আ.) আল্লাহর নবী মাত্র, ইলাহ নন। আখিরাতে সকলকে তাঁর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। এই সূরা বিশ্বাসীদের ঈমানকে বিশুদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক করার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে।
আরও পড়ুনঃ নাসিরনগরে ছাত্রদলনেতা খুনের মামালা,গ্রেফতার হয়নি কোন আসামী
*৩. সূরা মায়েদায় বর্ণিত আমলে সালিহা (সৎকর্ম):* প্রতিশ্রুতি পূরণ করা (আয়াত-১); আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য প্রদান করা (৮); ইনসাফ বা ন্যায়বিচার করা (৮); সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভালো কাজ ও তাকওয়ায় একত্র হওয়া (২); শত্রুকেও ইনসাফের সঙ্গে বিচার করা; ওজু করা (৬); নামায কায়েম রাখা এবং যাকাত প্রদান (৫৫); আহলে কিতাবের সাথে উত্তম ব্যবহার; সত্য গ্রহণে আন্তরিক হওয়া; ব্যভিচার, চুরি, খুন ইত্যাদি পরিহার করা; ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধান মেনে চলা।
*৪. সূরা মায়েদায় বর্ণিত হারাম ও হালাল:*_(ক). হারাম বিষয় সমূহ:_ মৃত জন্তু; রক্ত; শুকরের মাংস; যবেহ না করে মারা প্রাণী; মূর্তির নামে উৎসর্গকৃত জন্তু; ভাগ্য নির্ধারণে শরিক হওয়া (তীর নিক্ষেপ ইত্যাদি); চুরি; ব্যভিচার; হত্যা; সুদ; দুর্নীতি; মিথ্যা সাক্ষ্য; মদ ও জুয়া; ইহরাম অবস্থায় শিকার; আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।
_(খ). হালাল বিষয় সমূহ:_ পবিত্র ও হালাল খাদ্য; আহলে কিতাবের (ইহুদি ও খ্রিস্টান) জবেহকৃত খাদ্য; আহলে কিতাব নারীদের বিবাহ বৈধ; উত্তম উপার্জন; হালাল উপায়ে পশু শিকার; পানীয় ও খাদ্যে পবিত্রতা।
আরও পড়ুনঃ প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তায় যশোরের বাগআঁচড়ায় শ্রমিক ইউনিয়নের ভোট গ্রহণ চলছে
*৫. সূরা মায়েদায় বর্ণিত ঐতিহাসিক কাহিনী (সংক্ষেপ):* সূরা মায়েদায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। (ক). মূসা (আ.)-এর সময় বনী ইসরাঈলের অমান্যতা এবং তাদের ওপর আরোপিত শাস্তি বর্ণিত হয়েছে—যেমন, ৪০ বছর মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর ঘটনা। (খ). হাবীল ও কাবীলের কাহিনীও এসেছে, যেখানে ঈর্ষার কারণে কাবীল হাবীলকে হত্যা করে। এ ঘটনায় মানুষ হত্যার পরিণতি ও মানবজীবনের মর্যাদা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। (গ). এছাড়া ঈসা (আ.)-এর উম্মতের আচরণ ও তাঁর কিয়ামতের দিনের সাক্ষ্য গ্রহণের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা আক্বিদাগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
*৬. নিদর্শন (Signs) যা বর্ণিত হয়েছে সূরা মায়েদা:* (ক). মানবজীবনের মর্যাদা ও একজনকে হত্যা মানে পুরো মানবজাতিকে হত্যা (৫:৩২)। (খ). হালাল-হারামের বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। (গ). তাকওয়াভিত্তিক নেতৃত্ব ও আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তি।
(ঘ). মদ, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্য নির্ধারণ শয়তানের কাজ। (ঙ). ঈসা (আ.)-এর মাধ্যমে প্রেরিত মু’জিযা (যেমন মৃতকে জীবিত করা)। (চ). দাওয়াত ও দুনিয়ার জীবনের পরীক্ষা হিসেবে মানুষের মুক্ত ইচ্ছা।
আরও পড়ুনঃ বগুড়ায় আবারো জোড়া খুন সাবেক প্রেমিকা বন্যা আহত: সাবেক প্রেমিক খুনি সৈকত গ্রেফতার
*৭. শিক্ষা, উপদেশ ও হিকমাহ:* (ক). প্রতিশ্রুতি পূরণে দীনদারিতার পরিচয় পাওয়া যায়; (খ). সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করলে শান্তি আসে; (গ). তাকওয়া ও আল্লাহভীতি জীবন পরিচালনার মূলনীতি; (ঘ). অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে সদাচরণ ও পারস্পরিক সহাবস্থান;
(ঙ). আল্লাহর বিধানকে প্রাধান্য না দিলে বিপর্যয় অনিবার্য; (চ). ইসলামী বিধানকে খেলাচ্ছলে নেয়া যায় না; (ছ). আল্লাহর বিধান মেনে চলা শ্রেষ্ঠ জীবনপথ; এবং (জ). একজন অপরাধী সমাজকেই ধ্বংস করতে পারে।
*৮. আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আলোকে:* সূরা মায়েদা একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য শরিয়তের মৌলিক ভিত্তিগুলোর বাস্তব প্রয়োগ তুলে ধরে। এতে বিচারিক স্বচ্ছতা, অপরাধের যথাযথ শাস্তি, ইনসাফ, মানবাধিকারের সম্মান, ধর্মীয় স্বাধীনতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মতো নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার আহ্বান রয়েছে। এটি ইসলামী আইনশাস্ত্রের (Fiqh) একটি অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুনঃ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভাবে ফরজ:
*৯. উপসংহার:* সূরা আল-মায়েদা মুসলিম জীবনের জন্য এক পরিপূর্ণ নীতিমালা। এতে শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক, নৈতিক ও আইনি দিক থেকেও স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। হালাল-হারাম, ইনসাফ, তাকওয়া, ঈমান ও শিষ্টাচার—সবকিছুর সম্মিলনে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান গঠন করে।
এই সূরার বার্তা (মেসেজ) হলো: একজন মুমিনের জীবন কেবল বিশ্বাসে নয়, কর্মে, নীতিতে ও দায়িত্বে গঠিত হতে হবে। আল্লাহর বিধানকে মেনে চললেই শান্তি ও সফলতা লাভ সম্ভব।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ১৮-০৭-২৫)