ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*মায়েদার নিদর্শন: ঈসা (আ.)-এর দো‘য়া, শিষ্যদের পরীক্ষা এবং আমাদের শিক্ষা*
_আমার বন্ধু ডা. মইন উদ্দিন আহমেদ নিচের প্রশ্ন গুলো করেছেন: “বন্ধু মুসা: ঈসা (আ.) জানতেন যে নিদর্শন চাওয়া তাঁর উম্মতের জন্য বিপদজনক হতে পারে, তার পরেও কেন তিনি মায়েদা (খাদ্যপূর্ণ পাত্র) চাইলেন? মায়েদা (খাদ্য) কি এসেছিল? যদি এসে থাকে তো বন্ধ হলো কেন? এখান থেকে আমাদের শিক্ষণীয় কি?_
*_বন্ধু মইন উদ্দিন: মা-শা-আল্লাহ! তুমি, খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছো I তোমার এই প্রশ্নগুলো অনেকেই মনে মনে করেন, কিন্তু অনেকে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ বোধ করেন। একে একে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজি—সংক্ষিপ্ততাও রাখছি, আবার প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দেওয়ার চেষ্টা করছি; ‘ওমা তাওফিকি ইল্লাবিল্লাহ’।_*
আরও পড়ুনঃ বগুড়া গাবতলীতে রাস্তার গাছ পড়ে মোটর সাইকেল ভাংচুর
_ভূমিকা:_ মানুষের মন চিরকালই অদৃশ্যের প্রতি কৌতূহলী। ইতিহাস জুড়ে বারবার মানুষ নবীদের কাছে নিদর্শন বা অলৌকিকতার প্রমাণ চেয়েছে, যেন তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। একই চিত্র দেখা যায় ঈসা (আ.)-এর শিষ্যদের মধ্যে, যারা আকাশ থেকে মায়েদা বা খাবারে পূর্ণ এক বিশেষ পাত্র অবতরণের দাবি করেছিলেন। যদিও ঈসা (আ.) তাদের প্রথমেই নিদর্শন চাওয়ার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন, তবু শিষ্যদের আবেদনে তিনি আল্লাহর কাছে দো‘য়া করেন।
কুরআন আমাদের জানায়, মায়েদা নেমেছিল, কিন্তু এর সঙ্গে কঠোর শর্তও ছিল—এরপর কেউ অবিশ্বাস করলে তার শাস্তি হবে ভয়ঙ্কর। এই ঘটনা নিছক ইতিহাস নয়; বরং ঈমান, নিদর্শন, পরীক্ষা এবং আল্লাহর অদ্বিতীয় ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের জন্য এক গভীর শিক্ষা। এই প্রবন্ধে আমরা এই ঘটনার পটভূমি, বাস্তবতা এবং এর শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করব।
আরও পড়ুনঃ কালিয়াকৈরে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়
*১. ঈসা (আ.) জানতেন যে নিদর্শন চাওয়া তাঁর উম্মতের জন্য বিপদজনক হতে পারে, তার পরেও কেন তিনি মায়েদা (খাদ্যপূর্ণ পাত্র) চাইলেন?*
প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারীরা (সাথীরা) বারবার বলছিলেন: “তারা বলল: আমরা তা থেকে খেতে চাই; আমাদের অন্তর পরিতৃপ্ত হবে; আমরা জেনে নেব যে, আপনি সত্য বলেছেন এবং আমরা সাক্ষ্যদাতা হয়ে থাকতে চাই”। (সূরা মায়েদা, ৫:১১৩)! ঈসা (আ.) প্রথমেই তাদের সাবধান করেছিলেন: “আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও।” (৫:১১২)!
অর্থাৎ, নিদর্শন চাওয়াই প্রমাণ করে ঈমানের দুর্বলতা। কিন্তু শিষ্যদের বারবারের অনুরোধে ঈসা (আ.) বুঝলেন, তাদের ঈমান আরও শক্ত করতে হলে দো‘আ করা দরকার। তাই তিনি আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন—তবুও এ শর্তে যে, যদি তারা মায়েদা পেয়ে আবার অস্বীকার করে, তবে কঠিন শাস্তি হবে।
সুতরাং, ঈসা (আ.) নিজে নিদর্শন চাওয়ার পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের অন্তর শক্ত করতে চাইলেন। এটি নবীর করুণার নিদর্শন।
*২. মায়েদা (খাদ্যপূর্ণ পাত্র) কি এসেছিল*
কুরআনে স্পষ্টভাবে আল্লাহ বলেন: “আমি অবশ্যই তা তোমাদের উপর অবতীর্ণ করব”। (৫:১১৫)! অর্থাৎ, মায়েদা নেমেছিল। অনেক মুফাসসিরের মতে, সেই মায়েদায় ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের খাবার ছিল, যা ঈসা (আ.)-এর শিষ্যরা এবং অন্যান্য লোকেরা খেয়েছিল।
আরও পড়ুনঃ মহাদেবপুরে ছাত্রদলের মশাল মিছিল
কিন্তু—কুরআন বা বিশুদ্ধ হাদীসে খাবারের বিস্তারিত বর্ণনা নেই, কী কী খাবার ছিল, কতদিন চলেছিল। তাই নিশ্চিতভাবে শুধু এটুকু বলা যায়: হ্যাঁ, মায়েদা এসেছে। কুরআন বলছে, এরপরও কেউ অবিশ্বাস করলে, তার জন্য শাস্তি হবে কঠিন।
*৩. মায়েদা বন্ধ হলো কেন:*
মায়েদার “পরিচালনা” বা পুনরাবৃত্তি বন্ধ হয়েছিল, কারণ এটি পরীক্ষার নিদর্শন ছিল, স্থায়ী সুবিধা নয়। আল্লাহ শর্ত দিয়েছিলেন: “অতঃপর যদি এর পরে তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী করে, তবে আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যা জগতের অন্য কোনো জাতিকে দিব না”। (৫:১১৫)!
অর্থাৎ, মায়েদা ছিল এককালীন পরীক্ষা। শিষ্যরা খেয়ে ঈমান দৃঢ় করেছিল। এরপর কোনো “রুটিন” হিসেবে মায়েদা অব্যাহত ছিল না। আল্লাহ বারবার নিদর্শন প্রদর্শন করেন না, যদি মানুষ শিক্ষা না নেয়।
*৪. এখান থেকে শিক্ষণীয় কী:*
_৪.১ নিদর্শন চাওয়া ঈমানের দুর্বলতা:_ অযথা মুজিজা চাওয়া উচিত নয়। ঈমান অদৃশ্যের উপর বিশ্বাস। “যারা গায়েবের উপর বিশ্বাস রাখে…” (সূরা বাকারা, ২:৩)!
_৪.২ আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতা:_ আল্লাহ চাইলে আকাশ থেকে মায়েদা নামাতে পারেন। কোনো কিছুই তাঁর জন্য কঠিন নয়।
আরও পড়ুনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারে জুলাই স্মৃতিচারণ
_৪.৩ নবীর দায়িত্ব সতর্ক করা:_ ঈসা (আ.) শিষ্যদের প্রথমেই সাবধান করেছিলেন। নেতার দায়িত্ব মানুষকে সঠিক পথে রাখার চেষ্টা করা।
_৪.৪ পরীক্ষা-পরবর্তী দায়িত্ব বেড়ে যায়:_ নিদর্শন পাওয়ার পর ঈমান রাখা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। নিদর্শন পাওয়ার পরও যারা অস্বীকার করে, তারা ভয়াবহ শাস্তির যোগ্য হয়।
*৫. দো‘য়া করতে দ্বিধা নয়:*
ঈসা (আ.) দো‘য়া করেছেন। আল্লাহর কাছে চাওয়া দোষের নয়, তবে সন্দেহ বা পরীক্ষা করার মানসিকতায় নয়।
*৬. শিরকের বিরোধিতা:*
মায়েদার ঘটনা প্রমাণ করে, ঈসা (আ.) ছিলেন আল্লাহর বান্দা। তিনিই নিজে কোনো অলৌকিক খাবার নামাননি। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। এতে তাওহীদের শিক্ষা প্রকাশ পায়।
*৭. উপসংহার:*
মায়েদার ঘটনা একদিকে আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন, অন্যদিকে সতর্কবার্তা। ঈসা (আ.) শিখিয়েছেন—নবী কখনো নিজ ক্ষমতায় কিছু করেন না, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। মুমিনের কাজ—অদৃশ্যের উপর বিশ্বাস রাখা, অযথা নিদর্শন না চাওয়া এবং দো‘য়ায় বিনম্র হওয়া।
আল্লাহ আমাদের এমন ঈমান দান করুন, যা নিদর্শন না চাইলেও যেন সেই ঈমান অটল থাকে।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ১৬-০৭-২৫)