ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*তাকদীর: আইন, নীতি, নৈতিকতা,*দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোকে:*
_ভূমিকা:_ তাকদীর—আল্লাহর পরিকল্পনা, পূর্বনির্ধারণ ও সর্বজ্ঞ জ্ঞানের ফলাফল—ইসলামী বিশ্বাসের একটি মৌলিক স্তম্ভ। এ বিশ্বাস মানবজীবনে যেমন প্রশান্তির উৎস, তেমনি ভুল বোঝাবুঝি ও অতিরিক্ত বিতর্ক কখনো কখনো এটিকে জটিল ও বিভ্রান্তিকর করে তোলে।
তাই তাকদীরের গভীরতা বোঝার জন্য একে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের চশমায় দেখা যথেষ্ট নয়; বরং একে আইন, নৈতিকতা, দর্শন ও বিজ্ঞান—এই চারটি অনুষঙ্গের আলোতেও পর্যালোচনা করা দরকার। এই প্রবন্ধে আমরা তাকদীরের বহুমাত্রিকতা ও এর জীবনঘনিষ্ঠতা বিশ্লেষণ করার প্রয়াস নেব।
*১. আইনগত (Legal) দৃষ্টিকোণ থেকে তাকদীর:* ইসলামী আইনের মূল ভিত্তি পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্যের (Maqasid al-Shari’ah) ওপর প্রতিষ্ঠিত— জীবন, বুদ্ধি, ধর্ম, সম্পদ ও বংশ রক্ষা। তাকদীরের বিশ্বাস এই পাঁচটি উদ্দেশ্যের সাথে সংহতভাবে কাজ করে:
_১.১ জবাবদিহি নীতির ভিত্তি:_ যেহেতু মানুষকে ‘ইচ্ছাশক্তি’ দেওয়া হয়েছে এবং তাকদীরও আংশিকভাবে পরিবর্তনযোগ্য (দো’য়া ও আমলের মাধ্যমে), তাই সে নিজের কাজের জন্য আইনগতভাবে জবাবদিহি। আল্লাহ কাউকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেন না।
_১.২ ন্যায়বিচারের ভিত্তি:_ কিয়ামতের দিন বিচারের বিচারক আল্লাহ স্বয়ং। তাকদীর মানব-ইচ্ছাশক্তিকে বাতিল করে না, বরং তার ওপর ভিত্তি করে শাস্তি বা পুরস্কারের আইন প্রণীত।
_১.৩ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা:_ তাকদীরের ওপর বিশ্বাস মানুষকে অপরাধপ্রবণতা বা হিংসা থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করে, কারণ সে জানে, যা ঘটেছে বা ঘটবে তা আল্লাহর জ্ঞানে আছে এবং কোনো অন্যায় অব্যাহত থাকবে না।
*২. নৈতিকতা (Ethical Perspective):* তাকদীর মানুষের নৈতিক অবস্থানকে সংহত করে:
_২.১ ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা:_ বিপদের সময় ধৈর্য, ও সফলতার সময় অহংকার না করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা—দুটিই তাকদীরের বিশ্বাস থেকে উৎসারিত নৈতিক গুণ।
_২.২ আশাবাদ:_ দুঃসময়ে ‘আল্লাহর ফয়সালা ভালোই হবে’—এই ধারণা মানুষকে হতাশা থেকে রক্ষা করে, যা একটি গভীর নৈতিক শক্তি।
_২.৩ দায়িত্ববোধ:_ যদিও তাকদীর বিশ্বাস করা হয়, তবুও ইসলাম কর্মবিমুখতা নিষিদ্ধ করেছে। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি তার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেই।
*৩. নীতিমূল্য (Moral Values):* তাকদীর বিশ্বাস ব্যক্তিগত ও সামাজিক নীতিমূল্যকে স্থির করে:
_৩.১ আত্মসমর্পণ (Submission):_ আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতা নৈতিক পরিশুদ্ধির এক রূপ।
_৩.২ ক্ষমাশীলতা:_ মানুষ উপলব্ধি করে, অনেক কিছু তার নিয়ন্ত্রণে নেই; ফলে অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও ক্ষমাশীলতা বৃদ্ধি পায়।
_৩.৩ ভবিষ্যত-চিন্তা:_ ভবিষ্যতকে আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে সততা, পরিশ্রম ও সত্যবাদিতার চর্চা করা তাকদীর-ভিত্তিক নৈতিক চেতনার অংশ।
*৪. দর্শনের আলোকে (Philosophical Perspective):* তাকদীর এক গভীর ঈশ্বর-মানব সম্পর্কের ধারণা।
_৪.১ দৈবতন্ত্র বনাম মানবস্বাধীনতা:_ ইসলামী দর্শনে তাকদীর ও ইচ্ছাশক্তি পরস্পরবিরোধী নয়। বরং উভয়ের সমন্বয়ে “তাওয়াক্কুল” (আল্লাহর ওপর নির্ভরতা) ও “তাসাব্বুব” (কারণ সৃষ্টি ও চেষ্টা)–এই দুটি পথ সমান্তরালে চলে।
_৪.২ আধুনিক অস্তিত্ববাদ (Existentialism):_ পশ্চিমা দর্শনের মতে, মানুষ তার জীবন গড়তে স্বাধীন, তবে ইসলাম বলে—তুমি স্বাধীন, তবে আল্লাহর পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে। এটা ‘guided freedom’-এর দার্শনিক ভিত্তি।
_৪.৩ নিয়তির দর্শন:_ কুরআনের সূরা হাদীদ, ৫৭:২২-২৩-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “পৃথিবীতে বা নিজেদের মাঝে যা-ই ঘটে, তা লাওহে মাহফুজে লেখা আছে” —এটি দেখায় যে নিয়তি পূর্ব নির্ধারিত হলেও মানুষ তার প্রতিক্রিয়ায় নৈতিক ও আত্মিক স্বাধীনতা রাখে।
আরও পড়ুনঃ এমটিবি ময়মনসিংহ বিভাগীয় টেনিস প্রতিযোগিতা ২০২৫
*৫. বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা (Scientific Reasoning & Analogy):* ইসলামী বিশ্বাস বিজ্ঞানবিরোধী নয়; বরং বাস্তবতার বিভিন্ন স্তরে তাকদীরের ধারণা অনুরূপ কিছু বৈজ্ঞানিক উপমা দিয়ে বোঝানো যেতে পারে:
_৫.১ Quantum Determinism vs. Free Will:_ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব যেমন “Heisenberg’s Uncertainty Principle” বা “Quantum Indeterminacy” — বলছে, প্রকৃতির অনেক কিছুই নির্ধারিত নয় বরং সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করে। এটা তাকদীরের মুআল্লাক অংশের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ—নির্ধারিত ফলাফল হতে পারে দো’য়া বা কাজের দ্বারা পরিবর্তনশীল।
_৫.২ Genetic Predisposition vs. Environmental Influence::_ আমাদের জিন-ভিত্তিক কিছু বিষয় পূর্বনির্ধারিত হলেও (যেমন চোখের রঙ), আচরণ, চিন্তা ও সাফল্য নির্ধারিত হয় আমাদের পরিবেশ, শিক্ষা ও চেষ্টার মাধ্যমে। এটি তাকদীরের দুটি ধরণের (মুবরাম ও মুআল্লাক) বৈজ্ঞানিক প্রতিচ্ছবি।
_৫.৩ Simulation Theory Analogy:_ আধুনিক প্রযুক্তিতে যেমন কোনো প্রোগ্রামারের কাছে গেমের সমস্ত পথ ও বিকল্প আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে, তেমনি আল্লাহও জানেন কোন কর্মের কী পরিণতি। কিন্তু খেলোয়াড় (মানুষ) তার সিদ্ধান্ত নিজেই নিচ্ছে। এখানে ‘অ্যালগরিদমিক ফোরনলেজ’ হলো আল্লাহর জ্ঞান, কিন্তু সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা মানুষে রয়েছে।
*উপসংহার:* তাকদীর কেবল একটি ধর্মীয় বিশ্বাস নয়—এটি জীবন ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি সুসংহত দৃষ্টিভঙ্গি। এটি মানুষকে:
(ক). আত্মবিশ্বাসী করে (কারণ সে জানে, চেষ্টা করলে ফল আসবে), (খ). বিনয়ী রাখে (কারণ সে জানে, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায়), (গ). ধৈর্যশীল করে (কারণ সে জানে, যা ঘটছে তাতে কল্যাণ আছে), এবং (ঘ). শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখে (কারণ সে জানে, সে জবাবদিহি করতে হবে)।
তাকদীরের সঠিক উপলব্ধি ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতার জন্য এক ভারসাম্যপূর্ণ, প্রগতিশীল ও শান্তিপূর্ণ পথরেখা।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ০৫-০৭-২৫)