লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানঃ
বাংলাদেশের আকাশে আজ আর কোনো চিল চায় না উড়তে—কারণ নিচে পড়ে আছে পাথরবিদ্ধ লাশ, রক্তে ভিজে আছে রাজপথ, আর স্তব্ধ হয়ে আছে পুরো জাতি। একজন মানুষ খুন হলো। কোনো গলির কোণে নয়, কোনো অন্ধকার রাতে নয়—প্রকাশ্যে, জনসম্মুখে, রাজপথে। কারণ? সে চাঁদা দেয়নি। অপরাধ? সে মাথা নত করেনি।
এই পাষাণ বাস্তবতা এখন নতুন কোনো ঘটনা নয়—এ এক অভ্যস্ততা। রাজনীতি এখন আর আদর্শ নয়, এ এক দানবীয় মোড়কে পুঁজিবাদী খুনের লাইসেন্স।চাঁদাবাজি এখন দলীয় ‘চেতনার’ অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর খুন হয়ে উঠেছে সাংগঠনিক ‘শৃঙ্খলা রক্ষা’র হাতিয়ার।
একটা মানুষ যদি পাথরের আঘাতে মরে যায়, তার মৃত্যুর দায় শুধু খুনির নয়—রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন, গণমাধ্যম—সবাই মিলে তাকে হত্যা করেছে।কারণ আমরা সবাই চুপ ছিলাম। আমরা দেখেও বলিনি, শুনেও লিখিনি, জানলেও দাঁড়াইনি। আমরা ভেবেছি, এ আমার গল্প নয়। কিন্তু খুনের গল্প কোনো একক ব্যক্তির গল্প নয়—এ জাতির ভবিষ্যতের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।
এই যে ছেলেগুলো চাঁদার জন্য দল বানায়, এই যে নেতারা মুখে উন্নয়নের মিছিলে ব্যস্ত, কিন্তু পেছনে ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে নিজেদের রাজকীয় ভবিষ্যৎ সাজায়—তারা আসলে রাজনীতির নামে একটা ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্তায়নের চিত্রকথা লিখছে। এরা আদর্শ চুরি করে, তারপর গলা চেপে ধরে সত্যের। এরা পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে, আর নিচে পাথর লুকিয়ে রাখে।
আরও পড়ুনঃ উত্তর হালিশহর থেকে উত্তর কাট্টলী পর্যন্ত ৩ দিনব্যাপি উচ্ছেদ অভিযান রবিবার থেকে
বাংলাদেশ আজ আর স্বপ্নের দেশে নেই। এ এখন ভয়াবহ এক অভিযানে নামা এক রাজনীতির কসাইখানা। যেখানে চাঁদা না দিলে ব্যবসা চলে না, কথা বললে গুম হয়ে যেতে হয়, প্রতিবাদ করলে শহীদ হওয়া লাগে।
সর্বনাশা এই রাজনীতি আমাদের বুকের ওপর বসে আছে কুৎসিত এক দৈত্য হয়ে—যার হাত চাঁদার খাতা চেপে ধরে, আর পা পিষে ফেলে প্রতিবাদ। মানুষ মরছে, পরিবার ভাঙছে, চোখে অশ্রু শুকিয়ে গেছে—কিন্তু নেতাদের ভাষায় এসব কিছুই ঘটেনি। তারা বলবে, “দুর্বৃত্তায়ন”, তারা বলবে, “দায়িত্ব নয় আমাদের”—কিন্তু এই পাথরের আঘাতের নিচে যে দেশটা ধ্বংস হচ্ছে, তা কার দায়?
আমরা যারা লিখি, তাদের শব্দও আজ অস্ত্র। এই কলম কালি নয়, রক্তে ভেজা। এই বাক্য অনুরোধ নয়, চ্যালেঞ্জ। এই ভাষা আর চুপ থাকবে না। এই ভাষা ধ্বংসের বিপক্ষে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, সেই সত্যের পক্ষে, যেটা এখন পাথরের নিচে চাপা পড়ে কাঁদছে।
বাংলাদেশ একদিন জেগে উঠবেই। তখন যারা চাঁদার নামে খুন করেছে, তারা মুখ লুকাতে পারবে না। তখন ইতিহাস নিজেই মুখ খুলে বলবে—“এই যে, এরা ছিল গণতন্ত্রের ঘাতক।”
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর