ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
_ভূমিকা:_ ইসলাম একটি সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। কুরআন ও সহীহ হাদীস মুসলমানদের জন্য চূড়ান্ত মানদণ্ড। তাই একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের সাথে এসব মৌলিক বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতে পারে না। বরং তাদের মধ্যে ঐক্যমত, ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ এবং ভ্রাতৃত্ব থাকা উচিত।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অহংকার, অর্থ-অহমিকা, জ্ঞান-অহমিকা, নেতৃত্ব, স্বার্থপরতা ও শয়তানের প্ররোচনার কারণে মুসলিমরা বিভেদে জড়িয়ে পড়ে। এই প্রবন্ধে আমরা ঐক্য ও বিভেদের বাস্তবতা, শয়তানের ভূমিকা এবং ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
*১. কুরআন ও সহীহ হাদীসে ঐক্য:*
আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন: “তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না “। (সুরা আলে ইমরান, ৩:১০৩)! এই আয়াত মুসলিমদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা যে, দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে কোনো প্রকার ভিন্নমত থাকার কোন সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বিদায় হজ্জের ভাষণেও বলেছেন যে, মুসলিমরা যদি কুরআন ও তাঁর সুন্নাহ মেনে চলে তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।
আরও পড়ুনঃ মনোহরগঞ্জে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় বৃদ্ধার মৃত্যু
*২. ভিন্নমতের বাস্তবতা ও শয়তানের ভূমিকা:*
তাহলে প্রশ্ন আসে, মুসলিমরা একে অপরের সাথে ভিন্নমতে পড়ে কীভাবে? এর উত্তর নিহিত আছে মানুষের অন্তর্নিহিত দুর্বলতায়, Ego, Pride, অহংবোধ, অহংকার, “আমি বেশী ধনী, আমি চেয়ে বেশি জ্ঞানী” এইসব ধারণা থেকে। এসব মানসিকতার পেছনে মূল প্ররোচক হলো শয়তান, যার কুমন্ত্রণা মানুষকে ভ্রান্তিতে ঠেলে দেয়।
কুরআনে ‘শয়তান’ শব্দটি ৮৮ বার এবং ‘ইবলিস’ ১১ বার এসেছে; মোট ৯৯ বার! আল্লাহ আমাদের শায়তান সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। সুতরাং শয়তানের প্ররোচনাকে প্রশ্রয় দিয়ে ভিন্নমতের নামে বিভেদ সৃষ্টি করা আসলে ইসলামি ভ্রাতৃত্বকে ধ্বংস করার শামিল।
*৩. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু:*
কুরআনে শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু বলা হয়েছে, সে নানাভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সে মানুষের অন্তরে ওয়াসওয়াসা দেয় (সুরা নাস: ৪-৫), পার্থিব জীবনকে শোভন ও আকর্ষণীয় করে তোলে (সুরা আনআম: ৪৩), মিথ্যার আশ্বাস ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় (সুরা নিসা: ১২০), মানুষের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা সৃষ্টি করে (সুরা মায়িদা: ৯১)।
শায়তান অশ্লীলতা ও পাপ কাজে প্ররোচনা দেয় (সুরা নূর: ২১), এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে মানুষকে ভুলিয়ে দেয় (সুরা মুজাদিলা: ১৯)। শয়তানের এই কুমন্ত্রণা ও প্রতারণা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ সর্বদা তাঁর আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন, “নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু; সুতরাং তোমরাও তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো।” (সুরা ফাতির: ৬)।
আরও পড়ুনঃ শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে কুমিল্লা সদর ক্যাম্পের উদ্যোগে নিরাপত্তা সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
*৪. আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দর্শনের আলোকে ঐক্য এবং বিভেদ:*
_(ক). আইনের দৃষ্টিতে:_ ঐক্য মানে হলো এমন একটি শক্তি যা সমাজকে সংঘাত থেকে রক্ষা করে এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি তৈরি করে।
_(খ). নীতির আলোকে:_ ঐক্য ন্যায়, সমতা ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠা করে; আর বিভেদ অন্যায়, বৈষম্য ও অশান্তির জন্ম দেয়।
_(গ). নৈতিকতার আলোকে:_ ঐক্য মানে সত্য, সততা ও ভ্রাতৃত্বের চর্চা; বিভেদ মানে মিথ্যা, অহংকার ও অবিচারের প্রসার।
_(ঘ). মূল্যবোধের আলোকে:_ ঐক্য সমাজকে শক্তিশালী করে তোলে; বিভেদ সমাজকে ভঙ্গুর করে দেয়।
_(ঙ). আর দর্শনের দৃষ্টিতে:_ ঐক্য হলো মানবতার উন্নতি ও সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়া, আর বিভেদ হলো পশ্চাদপসরণ ও ধ্বংসের পথ।
_(চ). ইসলামের দৃষ্টিতে:_ ঐক্যই হলো অগ্রগতির আলো, আর বিভেদ হলো শয়তানের অন্ধকার ফাঁদ।
*৫. উপসংহার:*
ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, ঐক্য হলো মুসলিম উম্মাহর শক্তি, আর বিভেদ হলো শয়তানের কুমন্ত্রণা। তাই একজন মুসলিমের উচিত কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করা এবং অহংকার ত্যাগ করা, স্বার্থপরতা ও শয়তানি প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকা।
আমরা যদি আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দর্শনের আলোকে ‘ঐক্য’কে ধারণ করি তবে মুসলিম সমাজ শান্তি, অগ্রগতি ও মর্যাদার শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। অন্যথায় বিভেদ আমাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। তাই আজকের শিক্ষা হলো, ‘ঐক্যকে আঁকড়ে ধরো, বিভেদ থেকে দূরে থাকো’।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ২৬-০৯-২৫)