ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*ঐক্যের ভিত্তি আল্লাহর ওহী: কুরআন ব্যাখ্যার দায়িত্ব এবং বিভাজনের পরিণতি*
_”কুরআন ব্যাখ্যার দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরীল (আ.) কুরআন এবং এর সমস্ত ব্যাখ্যা ওহী হিসেবে নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেই কুরআন এবং এর ব্যাখ্যা তাঁর সাহাবাদের নিকট যথাযথভাবে পেশ করেছেন। কুরআন এবং এর ব্যাখ্যা উভয়ই ওহীর অন্তর্ভুক্ত একটি মহান আমানত, যা এই প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে, আল-হামদু লিল্লাহ।”_
_ভূমিকা:_ মুসলিম জাতি একসময় নেতৃত্ব দিত বিশ্বকে। আজ তারা বিপর্যস্ত, বিভক্ত, দুর্বল ও নির্যাতিত। এর মূলে রয়েছে একটি গভীর সংকট, ঐক্যের অভাব। অথচ কুরআন সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে যে, মুসলিমদের ঐক্য ও পথ চলার একমাত্র ভিত্তি হবে আল্লাহর প্রেরিত ওহী তথা কুরআন। সেই ওহী তথা কুরআনের ব্যাখ্যা ও বাস্তব অনুশীলনের জন্য আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকেই ব্যবস্থা করেছেন। ফলে, কুরআনের দৃষ্টিতে দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে ঐক্যহীনতা সৃষ্টি করাকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ আত্মশুদ্ধির পথ ও মুর্শিদের সোহবতের অপরিহার্যতা
*কুরআন ব্যাখ্যার দায়িত্ব আল্লাহর: সূরা কিয়ামাহ ও সূরা নাহলের প্রমাণ*
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআন ব্যাখ্যার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন, যাতে কেউ যেন এই ইলাহী গ্রন্থ তথা কুরআনের অর্থ ও উদ্দেশ্য বিকৃত করতে না পারে।
_কুরআনে আল্লাহ বলেন:_ “তোমার জিহ্বাকে কুরআনের জন্য নড়াচড়া করো না, তা শিখে নেয়ার জন্য। নিশ্চয়ই এর সংগ্রহ এবং পাঠ আমাদের দায়িত্ব। অতঃপর যখন আমরা একে পাঠ করি, তখন তুমি তার পাঠ অনুসরণ কর। এরপর এর ব্যাখ্যা করা আমাদেরই দায়িত্ব”। (সূরা কিয়ামাহ: ১৭-১৯)!
এই আয়াতগুলো সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, কুরআনের পাঠ, সংরক্ষণ এবং ব্যাখ্যার ভার আল্লাহ নিজে নিয়েছেন।
_আরও বিস্তারিতভাবে আল্লাহ বলেন:_ “আর আমরা আপনার প্রতি স্মরণীয় উপদেশ (যথা কুরআন) নাজিল করেছি, যাতে আপনি মানুষের কাছে যা নাজিল করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা করতে পারেন এবং যেন তারা চিন্তা করে।” (সূরা নাহল ১৬:৪৪)!
_এবং আল্লাহ আরো বলেন:_ “আর আমরা তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যারা এ বিষয়ে মতভেদ করে তাদেরকে সুম্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য এবং মু’মিনদের জন্য হিদায়েত এবং রহমতস্বরূপ।” (সূরা নাহল ১৬:৬৪)!
এই দুটি আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, কুরআনের ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল এবং সেটি আল্লাহর নির্দেশেই।
আরও পড়ুনঃ মধুপুরে জুলাই পুনর্জাগরণে সমাজ গঠনে শপথ পাঠ ও আলোচনা সভা
*ওহী ও ব্যাখ্যা: ফিরিশতা রাসূল জিবরীল (আ.) থেকে মানব রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মাধ্যমে*
কুরআনের ওহী আল্লাহ নাজিল করেছেন ফেরেশতা রাসূল জিবরীল (আ.)-এর মাধ্যমে। তিনি ওহী শুধু পাঠ করেই দেননি, বরং তার ব্যাখ্যা সহকারে নাজিল করেছেন। যেমন: “নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত এক রাসূলের আনীত ওহী, যে শক্তিশালী, আর আরশের মালিকের কাছে মর্যাদাসম্পন্ন।” (সূরা তাকভীর: ১৯-২০)! এখানে “রাসূল” বলতে বোঝানো হয়েছে জিবরীল (আ.)-কে, যিনি ওহী নিয়ে মানব রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) নিকট এসেছেন।
এরপর মানব রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) সেই ওহী ও তার ব্যাখ্যা সাহাবীদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক ছিল কুরআন কেন্দ্রিক, তাঁর কথা, কাজ এবং সিদ্ধান্তসমূহ, সবই ছিল কুরআনের ব্যাখ্যার বাস্তবরূপ। একে বলা হয় “সুন্নাতে-রাসূল”, যা কুরআনের প্রয়োগিক দিককে তুলে ধরেছে।
*সুন্নাহ ও ঐক্যের ভিত্তি:*
_রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলছেন:_ “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরবে, ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না, আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ”। (মুয়াত্তা মালিক, হাদীস: ১৬২৮)
সুন্নাহ হলো কুরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা। কুরআন এবং সুন্নাহই মুসলিমদের জন্য একমাত্র ঐক্যের ভিত্তি। কিন্তু আজ মুসলিমরা বিভক্ত হয়েছে মাজহাব, তরিকাহ, দল, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র ও নেতৃত্বের ভিন্নতায়। প্রত্যেকেই নিজেদের পথকে “সুন্নাহভিত্তিক” দাবী করে, অথচ বিভেদ ও শত্রুতার আগুনে জ্বলছে উম্মাহ।
আরও পড়ুনঃ নরসিংদীতে যথাযথ মর্যাদায় (জুলাই গণঅভ্যুত্থান)স্মরণে সিক্স-এ-
_দলীয় বিভক্তির পরিণতি:_ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া। আল্লাহ সাবধান করে বলেছেন: “তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা পরস্পর বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং স্পষ্ট আয়াত আসার পরও মতভেদে লিপ্ত হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।” (সূরা আলে ইমরান ৩:১০৫)!
_এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করেছেন:_ “আমার উম্মত ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে; একমাত্র একটি দল ছাড়া সবাই জাহান্নামে যাবে”। (তিরমিযী: ২৬৪১)!
এখানে বাঁচা সম্ভব একমাত্র সেই দলের জন্য, যারা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ আঁকড়ে ধরে। দলীয় গোঁড়ামি, ব্যক্তিপূজা বা রাজনৈতিক মতাদর্শ ঈমানের মানদণ্ড হতে পারে না।
আরও পড়ুনঃ গাইবান্ধায় সিজু হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ, থানার ওসির অপসারণের দাবি
*উপসংহার:* আজ মুসলিম উম্মাহর ঐক্যহীনতা, দুঃখ, নির্যাতন ও পরাজয়ের মূলে রয়েছে ঐক্যের ভিত্তি থেকে সরে যাওয়া। মুসলিমদের একমাত্র শক্তি আল্লাহর কুরআন এবং সুন্নাতে-রাসূল। এই ঐশী পাথেয় ব্যাখ্যার দায়িত্বও আল্লাহ নিজে গ্রহণ করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দিয়ে তা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। অতএব, যারা দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে এক পথভ্রষ্ট জাতিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় থাকে।
_আজ আমাদের করণীয় হলো:_ ঈমানের মানদণ্ডে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহর সঠিক অনুসরণ করা এবং দলীয় বিভাজনের দুঃসহ পরিণতি থেকে নিজেদের রক্ষা করা।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ২৬-০৭-২৫)