ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*ঈসা (আ.) রুহুলুল্লাহ: ভালোবাসা ও হিকমাহর দাওয়াহ*
*১. ঈসা (আ.)-এর পরিচিতি ও দাওয়াতি জীবনের সারসংক্ষেপ:* ঈসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইল জাতির প্রেরিত মহান নবী ও রাসূল। তিনি পিতা-ছাড়াই অলৌকিকভাবে মাতা মরিয়ম (আ.)-এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহ তাঁকে নবুয়ত দান করেন, ইনজীল কিতাব প্রদান করেন এবং তাঁকে বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন—যেমন মৃতকে জীবিত করা, জন্মান্ধকে সুস্থ করে তোলা ইত্যাদি। কিন্তু এসব ক্ষমতা ছিল আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষ। তিনি প্রেম, ক্ষমা ও উদারতার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন।
কুরআনে বলা হয়েছে: “আমি তাকে কিতাব, হিকমাহ, তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছি।” (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত ১১০)। তাঁর দাওয়াহর মৌলিক রূপ ছিল: আত্মার পরিশুদ্ধি, অন্তরের সংশোধন, পরিশুদ্ধ আত্মার বার্তা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষকে সৎ পথে আহ্বান।
*২. ঈসা (আ.)-এর কাহিনী:* এক নীতিমূলক শিক্ষা: ঈসা (আ.)-এর কাহিনীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমূলক শিক্ষা হলো—উত্তরের বদলে ধৈর্য ও দয়ালু আচরণ। যখন বনি ইসরাইল তাঁকে ও তাঁর মা মরিয়মকে অপবাদ দিতে থাকে, তিনি উত্তেজিত না হয়ে সৎ পথে আহ্বান চালিয়ে যান।
তাঁর এমন এক নিদর্শন: “আর তিনি আমাকে করেছেন বারকতময়, যেখানেই আমি থাকি। আর তিনি আমাকে আদেশ দিয়েছেন সালাত ও যাকাত আদায় করতে, যতদিন আমি জীবিত থাকি”। (সূরা মারইয়াম, আয়াত ৩১)। এই আয়াতে দেখা যায়, ঈসা (আ.) সমাজসেবার, উপদেশদানের ও আল্লাহর হুকুম পালনের মাধ্যমে দাওয়াহ করেছেন—কখনো হিংসা নয়।
আরও পড়ুনঃ হালাল উপার্জনের লক্ষ্যে শ্লোগান নিয়ে, কর্মশালা ও নৈশভোজ করে অনলাইন গ্লোবাল শপ ( অজিএস) লি.
*৩. হিকমাহর আলোকে ঈসা (আ.)-এর জীবন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা:*
_(ক). নম্র ভাষা ও কোমলতা:_ ঈসা (আ.) কঠোরতা নয়, বরং ভালোমানুষি ও কোমলতার মাধ্যমে কথা বলতেন। তিনি হৃদয়কে আকর্ষণ করতেন উদাহরণ দিয়ে ও সহজ কথায়।
_(খ). ক্ষমা ও দয়া:_ তিনি বারবার ক্ষমা ও সহানুভূতির শিক্ষা দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে: “তোমরা যদি ঈসা ইবনে মারইয়ামের অনুসারী হও, তবে নম্র হও, ক্ষমাশীল হও, এবং শান্তির বাণী ছড়াও”। (অর্থভিত্তিক সারাংশ)।
_(গ). উদাহরণমূলক শিক্ষা পদ্ধতি:_ ঈসা (আ.) অনেক সময় উপমা দিয়ে শিক্ষা দিতেন—যেমন দুনিয়ার মোহ বা অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকার উপদেশে তিনি পাখির বা বীজের দৃষ্টান্ত দিতেন।
_(ঘ). আত্মশুদ্ধি ও অন্তরনির্ভরতা:_ ঈসা (আ.)-এর দাওয়াহ বাহ্যিক আচরণ নয়, বরং মনের গভীর পরিবর্তনের উপর জোর দিত। কুরআনে আল্লাহ বলেন: “তিনি তাদের হৃদয় বিশুদ্ধ করতেন এবং কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দিতেন।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:৪৮)।
*৪. আল-কুরআনে ঈসা (আ.)-এর কাহিনী:* হিকমাহ ও নিদর্শনের আলোকে: কুরআনে ঈসা (আ.)-এর জীবন একাধিক সূরায় (আলে ইমরান, মারইয়াম, মায়েদা, নিসা, সফ) বিশ্লেষিত হয়েছে। কিছু বিশেষ দিক:
_(ক). তাওহীদের দাওয়াহ:_ তিনি নিজেকে আল্লাহর ইবাদতকারী বান্দা হিসেবে পরিচয় দেন। কুরআনে তিনি বলেন: “নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী করেছেন (সূরা মারইয়াম, আয়াত ৩০)”।
_(খ). অভিনব মু‘জিযা:_ কাদামাটির পাখি বানিয়ে উড়িয়ে দেওয়া, রোগ সারানো, মৃতকে জীবিত করা—সবই ছিল আল্লাহর অনুমতিসাপেক্ষে। এসব মু‘জিযা ছিল ঈমানদারদের জন্য নিদর্শন এবং হিকমাহ।
_(গ). ভ্রান্ত আকীদার বিরোধিতা:_ ঈসা (আ.) নিজে কখনো আল্লাহর অংশ বা পুত্র হওয়ার দাবি করেননি। বরং কুরআনে বলা হয়েছে: যখন আল্লাহ বলবেন, ‘হে ঈসা ইবনে মারিয়াম, তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর?’
ঈসা (আ.) বলবেন, হে আমার রব্ব: ‘তুমিই মহিমান্বিত, যা বলার অধিকার আমার নেই, তা বলা আমার জন্য আদৌ শোভনীয় নয়। যদি আমি বলে থাকি, তাহলে তা তো তুমি অবশ্যই জানো। আমার নাফসে কি আছে, তা তুমি অবগত আছ। কিন্তু তোমার নাফসে যা আছে, আমি তা অবগত নই, নিশ্চয় তুমি অদৃশ্য সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত। (সূরা আল-মায়েদা, ৫:১১৬)।
*৫. উপসংহার:* ঈসা (আ.) ছিলেন করুণা, ক্ষমা ও ভালোবাসার প্রতীক। তিনি কেবল অলৌকিক ঘটনা দ্বারা নয়, বরং হৃদয়গ্রাহী আচরণ, হিকমাহপূর্ণ ভাষা এবং আদর্শ জীবনযাপন দ্বারা মানুষের অন্তর জয় করেছেন। তাঁর দাওয়াহর কেন্দ্রবিন্দু ছিল আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনা—ভালোবাসা ও নম্রতার মাধ্যমে।
*৬. অতিরিক্ত দিক: ঈসা (আ.)-এর পুনরাগমন — ভবিষ্যৎ হিকমাহ:* ইসলামী আকীদা অনুযায়ী, কিয়ামতের পূর্বে ঈসা (আ.) পৃথিবীতে পুনরায় আগমন করবেন এবং তাঁকে আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র মনে করা খ্রিষ্টানদের ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করবেন। তিনি যাবতীয় অন্যায় ও শিরক থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করবেন এবং ইসলাম পুন:প্রতিষ্ঠা করবেন। এটি একটি মহা-হিকমাহ যা ভবিষ্যতের দাওয়াহ আন্দোলনের জন্য দৃষ্টান্ত।
শেষ কথা: ঈসা (আ.)-এর দাওয়াহর কৌশল আমাদের শেখায়—কোনো আক্রমণ বা কঠোরতা নয়, বরং ভালোবাসা, উদারতা এবং হিকমাহপূর্ণ কথা ও কাজের মাধ্যমেই হৃদয় জয় করা যায়। আজকের সমাজেও তাঁর পদ্ধতি অনুসরণ করলে শান্তি, সহানুভূতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ০৬-০৭-২৫)।