ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*দেশে দেশে মূর্তি পূজা: শায়তানের কুটকৌশল*
*১. ভূমিকা:* মূর্তিপূজা মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রাচীনতম বিভ্রান্তি। যুগে যুগে শয়তান মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে সরিয়ে মূর্তির উপাসনায় লিপ্ত করেছে। প্রাথমিকভাবে স্মৃতিরক্ষা কিংবা সৌন্দর্যবোধের নাম করে মূর্তি তৈরি হলেও, শয়তানের কৌশলে তা ক্রমেই পূজার রূপ নেয়।
আজকের বিশ্বে মূর্তিপূজা ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নানাভাবে বিস্তৃত। বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ভাস্কর্যের নামে মূর্তির প্রচলন, ব্যক্তি বন্দনা এবং অতিমাত্রায় তাযিম ইসলামি আকীদার সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ, সেই আলোচনাই এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু।
আরও পড়ুনঃ কালিয়াকৈরে কালের কন্ঠ মাল্টিমিডিয়ার বর্ষপুর্তি উদযাপন
*২. দেশে দেশে মূর্তি পূজা: শায়তানের একটি বিরাট চাল:* মূর্তিপূজা মানুষের অতিপ্রাচীন একটি বিভ্রান্তি। মূলত শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ আল্লাহর পরিবর্তে দুনিয়ার বস্তুকে উপাস্য করে ফেলে। মানুষ প্রথমে প্রিয় ব্যক্তির স্মৃতিরক্ষায় বা সৌন্দর্যের জন্য ভাস্কর্য বা মূর্তি তৈরি করলেও, শয়তান ধীরে ধীরে মানুষকে সেই মূর্তিগুলোকেই উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করতে প্ররোচিত করে।
আল্লাহ কুরআনে বলেন: “তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”। (সূরা আল-বাকারা, ২:১৬৮)!
*৩. পৃথিবীর যে সব দেশে সবচেয়ে বেশি মূর্তিপূজা হয়; এবং মূর্তি বানানো হয়:* বিশ্বে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও শিখধর্মের অনুসারীরা মূর্তি বা ভাস্কর্য পূজায় জড়িত। ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, প্রভৃতি দেশে মূর্তি ও ভাস্কর্য পূজা অত্যন্ত প্রচলিত। শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও নেতাদের মূর্তি বহু দেশে তৈরি ও পূজিত হয়।
*৪. বাংলাদেশে ‘ভাস্কর্য’ এর নামে মূর্তির প্রচলন:* বাংলাদেশ মূলত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। ইসলামে মূর্তি বা ভাস্কর্য তৈরির বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে “শিল্পকর্ম” বা “ভাস্কর্য” নামে নানা ধরনের মানবাকৃতি বা জীবন্ত প্রাণীর মূর্তি স্থাপন দেখা যায়। শহরের মোড়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় ভবন, সাংস্কৃতিক চত্বর—এখন এসবের আড়ালে এক ধরনের “মূর্তির” প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে।
*৫. ব্যক্তি বন্দনা, ভাস্কর্য প্রসার এবং মূর্তিপূজা:* বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘পল্লিবন্ধু’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘শিখা অনির্বাণ’, ‘স্বাধীনতার ভাস্কর্য’, ‘শহীদ মীনার’, ‘ভাষা আন্দোলনের ভাস্কর্য’, কবি ও সাহিত্যিকদের ভাস্কর্য ইত্যাদি—এই ধারণার অন্তরালে ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে তাঁদের বহু ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রেই এই ভাস্কর্যগুলোকে কেন্দ্র করে ফুল দেওয়া, মাল্যদান, প্রণাম বা ‘বন্দনা’র মতো কর্মকাণ্ড করতে দেখা যায়, যা ‘তাযিম’ বা অতি সম্মানের নামে কখনো কখনো শিরকের সীমারেখায় পৌঁছে যায়। এটি ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্কিত, কারণ ইসলামে কোনো মানুষের মূর্তি তৈরিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সর্বোপরি, সেই সব মূর্তির সামনে সম্মান প্রদর্শন করা ইসলামী আকীদার সম্পূর্ণ বিপরীত।
*৬. কুরআনের আলোকে মূর্তিপূজা এবং প্রেরিত নবী ও রাসূলদের প্রতিরোধ:* কুরআন বহুবার মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে। আল্লাহ বলেন: “তোমরা নিশ্চয়ই এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের পূজা করেছ, তারা আমার শত্রু, তবে ইবরাহিম ছাড়া।” (সূরা আশ-শু‘আরা, ২৬:৭৫-৭৬)!
নূহ, ইবরাহিম, মূসা, ঈসা (আ.) এবং মুহাম্মদ (ﷺ) সহ সকল নবী ও রাসূল মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে জেহাদ করেছেন। তাঁরা তাওহীদের শিক্ষা দিয়েছেন—এক আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত না করতে।
*৭. আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আলোকে মূর্তিপূজা:* বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামের আলোকে মূর্তিপূজা, কিংবা কোনো ব্যক্তিকে অতিমাত্রায় মহিমান্বিত করা, ইসলামী নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
রাষ্ট্রীয় নীতি ও সমাজের নৈতিকতার দিক থেকেও মূর্তিপূজা বা এর মতো কর্মকাণ্ড সামাজিক বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে। আবার, শিল্পকর্মের নামে অতিরিক্ত ব্যক্তি-পূজা রাষ্ট্রীয় সম্প্রীতিকে ব্যাহত করতে পারে।
*৮. উপসংহার:* মূর্তিপূজা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শয়তানি ফাঁদ। কুরআন মানুষকে এই ফাঁদ থেকে মুক্ত থাকতে শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশে ইসলামী শিক্ষা, তাওহীদের চেতনা ও শিরক থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি।
ভাস্কর্য বা মূর্তির নামে যে কোনো কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্রীয় সংহতির দিক বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ। আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ০১-০৭-২৫)