এম, জি, মস্তফা মুসাঃ
*ইবাদতে মধ্যপন্থা অবলম্বন: সুন্নাহর* *আলোকে সঠিক জীবন দর্শন*
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনজন লোক নবী কারীম (ﷺ)-এর স্ত্রীদের বাড়িতে এলেন এবং নবী (ﷺ)-এর ইবাদতের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। যখন তাদেরকে জানানো হলো, তখন তারা নিজেদের কাছে সেটাকে অল্প মনে করলেন। তারা বললেন: “আমাদের অবস্থান নবী (ﷺ)-এর মতো কোথায়! আল্লাহ তো তাঁর অতীত ও ভবিষ্যতের গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।”
তাদের একজন বলল: “আমি সারারাত জেগে সালাত আদায় করব।” আরেকজন বলল: “আমি সারাজীবন সিয়াম রাখব, কখনো ইফতার করব না”। আরেকজন বলল: “আমি নারীদের থেকে দূরে থাকব, কখনো বিয়ে করব না।”
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের কাছে এসে বললেন: “তোমরাই কি এই কথাগুলো বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি এবং বেশি তাকওয়া অবলম্বন করি। কিন্তু আমি সিয়াম রাখি আবার ইফতারও করি; সালাত আদায় করি আবার ঘুমায়; আর আমি স্ত্রীদের সাথে বিবাহ করি। যে আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ হবে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়”। (সহীহ বুখারী: হাদীস-৫০৬৩; সহীহ মুসলিম: হাদীস-১৪০১)!
*১. হাদীসের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ:*
এই হাদীসের মূল বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
_(ক). মধ্যপন্থা ও সমন্বয়:_ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) স্পষ্টভাবে দেখালেন যে আল্লাহর ভয় (তাকওয়া) ও আল্লাহর উপর নির্ভর (তাওয়াক্কুল) থাকা সত্ত্বেও জীবনব্যবস্থায় সহজতর ও বাস্তবানুগ ভারসাম্য রাখা উচিত, যেমন সিয়াম রাখেন, তবে ইফতারও করেন; রাতে সালাত আদায় করেন, তবে নিদ্রাও যান; বিবাহ করেন। অর্থাৎ ধার্মিকতা কখনোই জীবনের সকল স্বাভাবিক নিয়ামত (খাদ্য, ঘুম, বিবাহ ইত্যাদি) বাতিল করার অনুমোদন দেয় না।
_(খ). সুন্নাহ-অনুসরণ অপরিহার্যতা:_ হাদীসের শেষ বাক্য—“যে আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ হবে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়”, এখানে সুন্নাহকে কেন্দ্রীয় পরিচয় হিসেবে স্থাপন করেছেন। সুন্নাহ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনযাপন ও আচরণ, এটা কেবল আচার-ব্যবহার নয়, বরং ইসলামের বাস্তবমুখী দিশা।
আরও পড়ুনঃ নাসিরনগরে চা দোকানীকে কুপিয়ে হত্যা
_(গ). চরমতাবাদের প্রতি সতর্কবার্তা:_ তিনজনের প্রতিটি উচ্চকণ্ঠ প্রতিশ্রুতি, সারারাত সালাত, সারাজীবন সিয়াম (একেবারেই ইফতার না করা), সারাটা জীবন বিয়ে ত্যাগ; এইসব চরমপন্থা ইসলামে প্রশংসিত নয়। কারণ এরা নিজেকে এতটাই কড়া সীমায় ঝুঁকিয়ে নিচ্ছে যে, ধর্মের সহজতা ও মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজনকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। নবী (ﷺ) এদেরকে বুঝিয়েছেন যে কর্মে ধার্মিকতা নয়, বরং স্থায়ী ভারসাম্য, নিয়মানুবর্তিতা এবং মানবিক দায়িত্ব, সব মিলে সঠিক পথ।
_(ঘ). ঈমান ও আমলের মধ্যে সামঞ্জস্য:_ নবী (ﷺ) বললেন তিনি আল্লাহকে আরও ভয় করেন, কিন্তু তবুও তিনি মানুষিক দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ ইবাদতই পরিচয় নয়; ইবাদতকে জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পালন করাই ইসলাম শিক্ষা দেয়।
*২. হাদীস থেকে শিক্ষা ও উপদেশ:*
এই হাদীস থেকে মূলত যে শিক্ষাগুলো পাওয়া যায়:
_(ক). সহজতা ও মধ্যপন্থা অবলম্বন:_ ইসলাম সহজ ও মধ্যপন্থা শিক্ষা দেয়। অত্যধিক ত্যাগ বা অমানবিক কঠোরতা ইসলাম অনুমোদন করে না।
_(খ). সুন্নাহ অনুসরণ অপরিহার্য:_ নবীর (ﷺ) জীবনই মাপদণ্ড; ব্যক্তিগত উদ্দামতা নয়।
_(গ). ইবাদতে ধারাবাহিকতা প্রয়োজন:_ খুব কঠোর হলেও যদি স্থায়ী না হয়, তা মূল্যবান নয়; সহজতা রেখে নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিত ইবাদত বেশি কায্যকর।
_(ঘ). দায়িত্বশীলতা:_ সামাজিক দায়িত্ব (পরিবার, সমাজ) উপেক্ষা করে যদি ইবাদত করা হয়, তা কায্যকর ফল কম দেয়।
_(ঙ) তাকওয়া ও তাওয়াক্কুলই লক্ষ্য:_ আত্মমর্যাদা ধ্বংস নয়, নিজের শরীরে, মন-মানসের ক্ষতি করে ইবাদত বাড়ানো ইসলাম অনুমোদন করে না। আল্লাহভীতি ও আল্লাহ নির্ভরতা আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত।
*৩. শরীয়তের আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে:*
_(ক). শরীয়তের আইন ও নীতি— সহজতা ও মধ্যমপন্থা:_ কুরআন ও হাদীসে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দার উপর সহজ করতে চান, কষ্ট দিতে চান না। ইসলামী আইন সবসময় মমতা, প্রবল প্রযোজ্যতা এবং মানুষের বলপ্রয়োগের সীমা বিবেচনা করে।
_(খ). নৈতিকতা ও মূল্যবোধ:_ ইসলামী নৈতিকতা বলছে, ইবাদত মানে কেবল ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধি নয়, পরিবেশ-মানুষ-দায়িত্বের সঙ্গে স সামঞ্জস্য রেখে কার্যকর নৈতিকতা প্রয়োগ। পরিবার ও সামাজিক সম্পর্কই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ (যেমন বিবাহকে উৎসাহিত করা)।
_(গ). দর্শন:_ ধর্মের দর্শন হলো মানবকে পূর্ণতা লাভে সাহায্য করা—শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সকল দিক বিবেচনায় রেখে। অতএব চরম ত্যাগ ধর্মের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করতে পারে।
*৪. ফিকহি মাসলা-মাসাইল (প্রয়োগগত ছক/আইনি প্রভাব, সংক্ষেপে):*
কিছু নির্দিষ্ট ফিকহি দিক এখানে গঠনযোগ্য:
_(১). বারংবার কঠোর অঙ্গীকার (যেমন সারাজীবন সিয়াম বা সারাজীবন অবিবাহিত) করলে কী হবে?:_ কোনো মুসলিম যদি নিজেই ব্যক্তিগতভাবে কোনো অতি কঠোর নিয়ম গ্রহণ করেন (যেমন নিত্য সারা রাত দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা, সারাজীবন নিঃস্বার্থ সিয়াম রাখা ইত্যাদি), তা ইসলাম ধার্মিকতায় অনুমোদিত নয়, কারণ শরীর-মন-সমাজের ক্ষতি হতে পারে।
যদি কেউ কোন কসম বা প্রতিজ্ঞা করে, অর্থাৎ বিশেষ কোনো কাজ আল্লাহর জন্য অঙ্গীকার হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে সাধারণত সেই কসম পূরণ দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে।
_(খ). বিবাহ ত্যাগ বিষয়ে ফিকহি অবস্থান:_ ইসলাম বিবাহকে উৎসাহিত করে; বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ ও সমাজের একটি ধ্রুবক স্তম্ভ হিসেবে দেখা হয়। বিবাহ ত্যাগ করা, যদি তা স্বেচ্ছায় ও ধর্মীয় অহংকার থেকেই হয়, তবে সেটি প্রশংসনীয় নয়। সন্ন্যাস (জীবনভর কামতালিকা ত্যাগ করা) ইসলামি শিক্ষা-ব্যবস্থায় ধ্রুপদী নয়। নবী (ﷺ)-এর চরিত্রগত সিদ্ধান্ত নিজেই প্রমাণ যে বিবাহ হালাল এবং সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয়।
_(গ). সিয়াম ও ইফতারের ব্যাপারে:_ ইবাদতে আইনগত নিয়ম আছে, যেমন সিয়ামের নিয়ম, ইফতার ইত্যাদি। সারাজীবন সিয়াম রাখার প্রতিশ্রুতি আইনগতভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শারীরিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে; পাশাপাশি এমন প্রতিশ্রুতি আল্লাহর দেয়া সহজতার নীতির বিরুদ্ধে।
_(ঘ). সংক্ষেপে:_ ফিকহি দৃষ্টিতে ইসলাম কোনো ব্যক্তিকে চরম কঠোর অনুশীলনে বাধ্য করে না; বরং যদি কেউ অতিরিক্ত কোনো প্রতিজ্ঞা করে, তাতে আইনগত ও নৈতিক বিচার হয়ে থাকে এবং প্রয়োজনে আলিমদের পরামর্শ নেয়া উচিত।
*৫. উপসংহার (সংক্ষিপ্ত সারমর্ম ও বাস্তব প্রয়োগ):*
এই হাদীসটি আমাদের শেখায়, ইসলাম অতিপ্রচণ্ড ত্যাগের ধর্ম নয়, বরং স্থায়ী, সমন্বিত ও দায়িত্বশীল ইবাদতের দ্বীন।
নবী (ﷺ) নিজে এমন আচরণ করে দেখিয়েছেন: তিনি আল্লাহর প্রতি বেশি নির্ভরতা ও ভীতি রাখতেন, কিন্তু তা হতাশা বা আত্মহত্যার মত রিগারী আচরণে পরিণত হত না; তিনি পরিমিত, সহনশীল ও সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল ছিলেন।
আমাদের ব্যক্তিগত ইবাদত প্রণালীগুলোকে এমনভাবে সাজাবো যাতে তা দীর্ঘস্থায়ী, স্বাস্থ্যসম্মত ও সামাজিক দায়িত্ব-সম্মত হয়। অতিমাত্রায় কঠোরতা প্রায়ই দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয় এবং ধর্মের মর্যাদা-লঙ্ঘন ঘটে।
শেষ করবো নবীর (ﷺ) নির্দেশনার সারমর্মে: সুন্নাহই আমাদের পথপ্রদর্শক; ব্যতিক্রমী আত্মতুষ্টি নয়।
আল্লাহ আমাদেরকে নবীর (ﷺ) সুন্নাহ অনুযায়ী, চরমপন্থা ছাড়াই, মধ্যপন্থায় চলা ও প্রগতিশীল ইবাদত করতে তৌফিক দান করুন, আমীন।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ২১-০৯-২৫)