ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
_সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত-৬৯:_
*وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ;*
“আর যারা আমার পথে চেষ্টা-সাধনা (জিহাদ) করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ মুহসীনদের (সৎকর্মপরায়ণদের) সাথে আছেন” (২৯:৬৯)।
*১. ভূমিকা:*
সূরা আল-আনকাবুতের শেষ আয়াতটি (আয়াত-৬৯) একটি গভীর নীতি ও প্রতিশ্রুতি বহন করে। এখানে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন যে, যারা তাঁর পথে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালায় (জিহাদ করে), তিনি তাদেরকে হিদায়াতের বিভিন্ন পথে পরিচালিত করবেন এবং তাঁর বিশেষ সঙ্গ ও সাহায্যে ধন্য করবেন। এ আয়াত মুমিনদের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণার উৎস, যত বাধা-বিপত্তিই আসুক, আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা কখনো ব্যর্থ হয় না।
*২. শানে নুযুল (অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট):*
এই আয়াতটি মূলত মক্কায় অবতীর্ণ হয় যখন মক্কায় মুমিনরা তীব্র নির্যাতন, অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সামাজিক বয়কটের শিকার ছিলেন। তখন অনেক সাহাবি মক্কা থেকে হিজরত করছিলেন, কেউ কেউ দ্বীনের দাওয়াত গোপনে দিচ্ছিলেন, আবার কেউ জ্ঞান অর্জন ও আমলের মাধ্যমে নিজেদের দৃঢ় রাখছিলেন। এ কঠিন সময়ে আল্লাহ ঘোষণা দিলেন, যারা আল্লাহর পথে চেষ্টা ও সংগ্রাম (জিহাদ) করবে, তিনিই তাদেরকে পথ দেখাবেন। অর্থাৎ, হিদায়াত ও সাফল্যের নিশ্চয়তা চেষ্টা ও ত্যাগের সাথে সম্পর্কিত। উল্ল্যেখ্য যে মক্কী জীবনে যুদ্ধ-কিতাল ফরজ হয়নি।
*৩. ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ:*
_৩.১. “যারা আমার পথে জিহাদ (চেষ্টা-সাধনা) করে”,_ জিহাদের ব্যাপক অর্থ: জিহাদকে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে:
_(ক). নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ:_ নিজের প্রবৃত্তি, কামনা, বাসনা, খেয়াল, খুশি ও শয়তানের প্ররোচনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।
_(খ). জ্ঞান অন্বেষণের জিহাদ:_ ইসলামী জ্ঞান অর্জন ও সঠিক আক্বিদায় দৃঢ় থাকা।
_(গ). দ্বীনের প্রচারের জিহাদ:_ আল্লাহর বাণী প্রচার, সত্যের সাক্ষ্য দেওয়া ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা।
_৩.২. “আমি তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব”, সুবুল (পথসমূহ) এর ব্যাখ্যা:_ সুবুল অর্থ এখানে বিভিন্ন স্তর ও শাখা, যা একই সরল পথে (সিরাতুল মুস্তাকিম) যুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে: সঠিক জ্ঞান, সৎ আমল, আল্লাহর নৈকট্য, দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের পথ।
_৩.৩. “আল্লাহ মুহসীনদের (সৎকর্মপরায়ণদের) সাথে আছেন”, আল্লাহর সঙ্গের প্রকারভেদ:_ (ক). সাধারণ সঙ্গ: জ্ঞান, দৃষ্টি, শ্রবণ ও ক্ষমতার মাধ্যমে সব সৃষ্টির সাথে থাকা। (খ). বিশেষ সঙ্গ: মুত্তাকী ও মুহসিনদের জন্য সাহায্য, সমর্থন, সুরক্ষা ও তাওফিক।
*৪. সদৃশ্য আয়াত ও হাদীস*
_(ক). সদৃশ্য আয়াত:_ “যারা আমাদের পথে জিহাদ (চেষ্টা- সংগ্রাম) করে, আমরা তাদের জন্য আমাদের পথগুলো উন্মুক্ত করে দিই”। (আল-আনকাবুত: ৬৯ নিজেই এর প্রধান উদাহরণ)!
আল্লাহর বাণী: “আর যারা হিদায়াতের পথে চলে, আল্লাহ তাদেরকে আরও হিদায়াত দান করেন।” (মুহাম্মদ: ১৭)! আল্লাহর বাণী: “নিশ্চয়ই আল্লাহ, তাঁর পথে যারা যুদ্ধ (সংগ্রাম) করে, তাদেরকে ভালোবাসেন”। (আস-সাফ: ৪)!
আরও পড়ুনঃপ্রাথমিকে সরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় সকলের অংশ গ্রহণের দাবি
_সদৃশ্য হাদীস:_ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “মুজাহিদ সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর আনুগত্যে নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে”। (তিরমিযী, হাদীস: ১৬২১)! “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের পথে চলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।” (মুসলিম)!
*৫. শিক্ষা ও উপদেশ:*
(ক). হিদায়াত প্রচেষ্টা ও ত্যাগের ফল বসে বসে পাওয়া যায় না। (খ). জিহাদ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য—নফস, জ্ঞান, দাওয়াত, সমাজসংস্কার। (গ). আল্লাহর বিশেষ সঙ্গ শুধু তাদের জন্য যারা সৎকর্মে উৎকৃষ্ট। (ঘ). জীবনে বাধা যতই আসুক, আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় না। (ঙ). সঠিক পথের প্রতিটি ধাপে আল্লাহর সাহায্য নিশ্চিত।
*৬. আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে:*
_(ক). আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে:_ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের নীতি কুরআনের অংশ; এটিতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতির ভিত্তি নিহিত।
_(খ). নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে:_ আন্তরিক প্রচেষ্টা ও নৈতিক সংগ্রাম ছাড়া কোনো সমাজ টেকসই উন্নতি পায় না।
_(গ). নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে:_ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ নৈতিক শুদ্ধতার মূল চাবিকাঠি।
_(ঘ). মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে:_ সত্য, ধৈর্য, ত্যাগ, অধ্যবসায় ও আল্লাহভীতি—এই আয়াতের মূল মূল্যবোধ।
_(ঙ). দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে:_ জীবন একটি ধারাবাহিক সংগ্রাম; আল্লাহর সাথে সংযুক্ত প্রচেষ্টাই মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করে।
*৭. অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:*
_(ক). আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে:_ অনেক গবেষক আলেমরা এই আয়াতকে আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির মৌলিক নীতি হিসেবে দেখেছেন।
_(খ). মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে:_ নাফসের জিহাদ মানুষকে ধৈর্যশীল, স্থিতিশীল ও আত্মনিয়ন্ত্রিত করে।
_(গ). সমাজ সংস্কারমূলক শিক্ষা:_ যদি ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা চালানো হয়, সমাজের অন্যায়-অবিচার দূর হবে, ইন-শা-আল্লাহ।
*৮. উপসংহার:* সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত-৬৯, প্রতিটি মুমিনের জন্য একটি জীবন্ত প্রেরণা, যতই বাধা আসুক, আল্লাহর পথে অবিচল থাকা মানেই হিদায়াত ও সাফল্যের নিশ্চয়তা। এই আয়াত প্রমাণ করে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রচেষ্টার প্রতিদান দেন, তাদের জন্য সত্যের দরজা খুলে দেন এবং বিশেষ সঙ্গ দিয়ে তাদের সম্মানিত করেন।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ১০-০৮-২৫)