ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*হাদীসের সনদ ও মতন: মাপকাঠি, গুরুত্ব এবং ইসলামী আইন ও নৈতিকতায় এর অবস্থান*
*১. ভূমিকা:* ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে হাদীসের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর প্রেরিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী, কর্ম, নীরব অনুমোদন এবং চরিত্র—সবই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত।
তবে এই বিশাল হাদীস ভাণ্ডার সংরক্ষণ করতে গিয়ে ইসলামিক জ্ঞানচর্চায় একটি কঠিন পরীক্ষা ছিল—কীভাবে জানা যাবে কোন হাদীস নির্ভরযোগ্য, আর কোনটি নয়? এই যাচাই-বাছাইয়ের পদ্ধতির মূল ভিত্তি হলো দুইটি অংশ: সনদ (Isnad) এবং মতন (Matn)। মুহাদ্দিসগণ এর জন্য নির্ধারণ করেছেন নির্দিষ্ট কিছু মাপকাঠি। ইসলামী আইন, নীতি ও নৈতিকতার আলোকে সনদ-মতনের গুরুত্ব অপরিসীম।
আরও পড়ুনঃ মুসলিম জাতিসত্তা এবং ১৯০৫ সালই হল বাংলাদেশের ভিত্তি মূল, পর্ব ০৮
*২. সনদ ও মতনের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব:*
_২.১ সনদের সংজ্ঞা:_ সনদ বলতে বোঝানো হয় সেই ধারাবাহিক বর্ণনাকারী শৃঙ্খল, যার মাধ্যমে কোনো হাদীস রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পর্যন্ত পৌঁছেছে। প্রত্যেক বর্ণনাকারীর পরিচয়, চরিত্র, এবং যোগ্যতা যাচাই করা হয়।
_২.২ মতনের সংজ্ঞা:_ মতন হলো হাদীসের মূল বক্তব্য বা কনটেন্ট। অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছেন, করেছেন, অনুমোদন দিয়েছেন, বা বর্ণনাকারীরা যা উল্লেখ করেছেন, সেই কথাগুলিই মতন।
_২.৩ সনদ ও মতনের বৈশিষ্ট্য:_
সনদ: (ক). বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতা। (খ). প্রত্যেকের জীবন-চরিত্র বিশ্লেষণ। (গ). নির্ভরযোগ্য সূত্র।
মতন: (ক). কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। (খ). ভাষাগতভাবে শুদ্ধ। (গ). শরীয়তের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। (ঘ). অতিরঞ্জন বা অযৌক্তিকতা থেকে মুক্ত।
গুরুত্ব: সনদ ও মতন যাচাই ছাড়া হাদীসের নির্ভরযোগ্যতা স্থির করা সম্ভব নয়। এর মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় হাদীসের মর্যাদা—সহীহ, হাসান, যঈফ বা মাওদূ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে মিথ্যা বর্ণনা করা ইসলাম ধর্মে সবচেয়ে কঠিন অপরাধের একটি। তাই এই যাচাই প্রক্রিয়া ইসলামী জ্ঞানের বিশুদ্ধতা রক্ষায় অপরিহার্য।
*৩. মুহাদ্দিসদের নিকট হাদীস গ্রহণযোগ্যতার পাঁচটি মাপকাঠি:*
মুহাদ্দিসগণ হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে পাঁচটি শর্ত নির্ধারণ করেছেন। এগুলোকে বলা হয় “শর্তে কাবুল হাদীস”। এগুলো হলো:
_৩.১ ইসনাদের সংযুক্তি (اتصال السند):_ বর্ণনাকারীরা একে অপরের কাছ থেকে সরাসরি শুনেছে বা সাক্ষাৎ করেছে। সনদে কোনো বিচ্ছিন্নতা (মুরসাল, মুনকাতি, মুআল্লাক ইত্যাদি) না থাকা।
_৩.২ বর্ণনাকারীর ন্যায়পরায়ণতা (عدالة الراوي):_ ঈমান, তাকওয়া, নৈতিকতা, সততা। প্রকাশ্যে পাপ বা মিথ্যাচার নেই।
_৩.৩ বর্ণনাকারীর শক্তিশালী স্মরণশক্তি (ضبط الراوي):_ মুখস্থশক্তি বা লিখিত নোটের নির্ভুলতা। হাদীসের শব্দ বা অর্থ পরিবর্তন না করা।
_৩.৪ শায বা অদ্বিতীয় না হওয়া (عدم الشذوذ):_ বেশি নির্ভরযোগ্য সনদের বিপরীতে না হওয়া।
_৩.৫ ‘ইল্লাত’ বা গোপন ত্রুটি মুক্ত হওয়া (عدم العلة القادحة):_ কোনো গোপন ত্রুটি নেই, যা অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ ধরতে পারেন।
এই পাঁচটি শর্ত পূরণ না হলে হাদীস দুর্বল বা বাতিল (মাওদূ) হিসেবে চিহ্নিত হয়।
আরও পড়ুনঃ উলিপুরে সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার
*৫. সনদ ছাড়া মতনের উপর আমল: প্রযোজ্যতা ও সীমাবদ্ধতা:*
_৫.১ প্রযোজ্য ক্ষেত্র:_ (ক). সাধারণ ইতিহাস বা উপদেশমূলক কথা, যা কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত। (খ). নৈতিক বা নীতিগত শিক্ষা। (গ). ইসলাম প্রচারের motivational content (তবে একে হাদীস হিসেবে দাবি করা যাবে না)।
_৫.২ প্রযোজ্য নয়:_ (ক). আকীদা, ঈমান ও বিশ্বাসের বিষয়। (খ). হালাল-হারাম নির্ধারণে। (গ). ইবাদাত, ফতোয়া বা শরীয়তের বিধান। (ঘ). শরিয়তের পরিপন্থী, অযৌক্তিক বা অতিরঞ্জিত বিষয়।
*৪. চার মাযহাবের সনদ গ্রহণের বৈশিষ্ট্য:*
চার মাযহাবের ইমামগণ হাদীস যাচাইয়ে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করেছেন—
_৪.১ হানাফি মাযহাব:_ ইমাম আবু হানিফা যুক্তির প্রাধান্য দিতেন। সনদ থাকলেও, যদি মতন কুরআন বা বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক হতো, তা গ্রহণ করতেন না।
_৪.২ মালিকি মাযহাব:_‘আহলুল মাদীনার আমল’কে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতেন।
_৪.৩ শাফি’ মাযহাব:_ সহীহ সনদকে ফিকহের ভিত্তি বানাতেন।
_৪.৪ হাম্বলি মাযহাব:_ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল সবচেয়ে বেশি সনদ নির্ভর ছিলেন।
*৫. সনদ ও মতনের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:*
ইমাম বুখারী বর্ণনাকারীর সাক্ষাৎ নিশ্চিত করতেন।
সনদের ত্রুটি যেমন: মুআল্লাক, মুরসাল, মুনকাতি, মুআদ্দাল জানা জরুরি। অযৌক্তিক, অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা মতনকে “মুনকার” বলা হয়।
*৬. আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আলোকে সনদ ও মতন:*
_৬.১ আইনগত দিক:_ শরীয়তের বিধান প্রণয়নে বিশুদ্ধ সনদ ও মতন অপরিহার্য।
_৬.২ নীতিগত দিক:_ সত্য, নির্ভরযোগ্যতা ও সততা ইসলামিক নীতির মূল।
_৬.৩ নৈতিকতা:_ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বর্ণনা করা কঠিনতম অপরাধ।
_৬.৪ মূল্যবোধ:_ ইসলাম নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিবেশনের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে।
*উপসংহার:* সনদ ও মতন—এই দুই ভিত্তি ইসলামী হাদীস শাস্ত্রের প্রাণ। সনদ আমাদের বলে দেয়, কোনো কথা কোথা থেকে এসেছে, আর মতন যাচাই করে, সেই কথা সত্য, যৌক্তিক এবং শরীয়ত-সম্মত কিনা। মুহাদ্দিসদের নির্ধারিত শর্তগুলো ইসলামের জ্ঞানভাণ্ডারকে বিকৃতি ও মিথ্যার হাত থেকে রক্ষা করেছে।
আজকের যুগে, যখন ভুয়া হাদীস ছড়িয়ে পড়ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে, তখন মুসলিম সমাজের জন্য একমাত্র রক্ষাকবচ হলো সনদের শৃঙ্খলা ও মতনের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ। একে জানা ও চর্চা করা ঈমান, ইবাদাত ও সমাজকে সঠিক পথে রাখার জন্য অপরিহার্য।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ'লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ'লামীন*। (মূসা: ০৬-০৭-২৫)
প্রধান উপদেষ্টাঃ ফরহাদ মাজহার
উপদেষ্টাঃ এস,এম নজরুল ইসলাম ভুইয়ামোঃ আমিনুল ইসলাম,
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আবুল হাসেম,
সহঃসম্পাদকঃ আলী নওয়াব খোকন,
বার্তা সম্পাদকঃ ইয়াছিন আরাফাত,
সহকারী বার্তা সম্পাদকঃ এম, আসমত আলী মিসু,
সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদকঃ আসাদুজ্জামান খান মুকুল,
www.dainikbanglarsangbad.com
ইমেইলঃ dainikbanglarsangbad490@gmail.com
প্রধান কার্যলয়ঃ বাড়ি নং ৩৫, রোড নং ৪, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইলঃ01736091515, 01716698621
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Copyright © 2025 dainikbanglarsangbad.com. All rights reserved.