যশোরের খোলাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকার ভয়ভীতি ও দুর্ব্যবহার শিক্ষার্থীদের স্কুল ছাড়ার প্রবণতা বেড়েছে, প্রশাসনের পদক্ষেপ দাবি অভিভাবকদের
জেমস আব্দুর রহিম রানা, যশোর:
যশোর সদর উপজেলার ভেকুটিয়া ক্লাস্টারের অন্তর্গত খোলাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হুমায়রা আক্তার নিশির বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শন, দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণের একাধিক অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ক্রমেই অচল হয়ে পড়ছে, আর শিক্ষার্থীরা একে একে অন্য বিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে।
স্থানীয় অভিভাবক ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওই শিক্ষিকা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের সামান্য ভুলেও গালিগালাজ করেন, কখনও কখনও শারীরিক শাস্তিও দেন। ফলে ছোট ছোট শিশুরা এখন বিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায়। একসময় হাসিখুশি ক্লাসরুমগুলোতে এখন নীরবতা, আর শিক্ষার্থীদের মুখে ভয়ের ছাপ।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী রয়েছে ৫৯ জন, কিন্তু নিয়মিত উপস্থিত হয় মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ জন। বিদ্যালয়টি দুই শিফটে পরিচালিত হলেও শ্রেণিকক্ষগুলো এখন প্রায় অচল অবস্থায়।
গত এক মাসেই অন্তত তিনজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়ে গেছে—শিশু শ্রেণির সাহিদা খাতুন, আয়েশা খাতুন (মা: মমতাজ পারভীন) এবং দ্বিতীয় শ্রেণির জাহিদুল ইসলাম (মা: মারুফা বেগম)।
অভিভাবক মমতাজ পারভীন বলেন, “আমার মেয়ের পড়াশোনার বিষয়ে কথা বলতে গেলে ওই শিক্ষিকা অফিস রুমেই আমাকে মারতে উদ্যত হন। প্রতিবাদ করলে তিনি গালাগাল করে হুমকি দেন। পরে আমার স্বামী বিষয়টি নিয়ে কথা বললে স্থানীয় বাজারে ডেকে ভয় দেখানো হয়।”
আরেক অভিভাবক মারুফা বেগম বলেন, “স্কুলে সন্তান পাঠাতে ভয় লাগে। শিশুরা ওই শিক্ষিকার নাম শুনলেই আতঙ্কিত হয়। শিক্ষকের আচরণ যদি এমন হয়, তাহলে শিশুরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারাবে।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, হুমায়রা আক্তার নিশি একটি প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হওয়ায় কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পান না। অভিযোগ করলে উল্টো হুমকির শিকার হতে হয় বলে দাবি করেছেন কয়েকজন অভিভাবক।
একজন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ওই শিক্ষিকার আত্মীয়রা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তাই কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে চায় না। ফলে শিশুদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হচ্ছে।”
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস শহীদ মনা বলেন, “বিষয়টি শুনেছি, আমরা নিজেরা সমাধানের চেষ্টা করছি।”
তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত শিক্ষিকা প্রধান শিক্ষকের আত্মীয় হওয়ায় তিনিও প্রকাশ্যে অবস্থান নিচ্ছেন না।
ভেকুটিয়া ক্লাস্টারের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি, উপজেলা শিক্ষা অফিসের সঙ্গে আলোচনা করে তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
যশোর সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার মাহিদুল ইসলাম জানান, “বিষয়টি তদন্তাধীন। রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আশরাফুল আলম বলেন, “উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে অভিযোগ ওঠার এক মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনো কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সহকারী শিক্ষক নিশির আচরণে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে। এতে বিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে এবং সহকর্মীদেরও বিব্রত অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।”
তাদের মতে, যদি সময়মতো প্রশাসন হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে বিদ্যালয়টির অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
স্থানীয় অভিভাবক ও সচেতন নাগরিকরা বলেছেন, “একজন শিক্ষিকার কারণে পুরো বিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। যদি প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আরও শিক্ষার্থী স্কুল ছাড়বে। এতে শুধু একটি বিদ্যালয় নয়, পুরো প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে।”
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষকতা পেশা সমাজে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ। সেখানে যদি কোনো শিক্ষক ভয়, রাগ বা অপমান দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে ওঠেন, তবে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা বলেন, “শিক্ষক মানে দিকনির্দেশক। কিন্তু সেই শিক্ষক যদি শিশুদের আঘাতের কারণ হন, তাহলে শিক্ষা নয়—অবিশ্বাস জন্মাবে।”
খোলাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ঘটনা এখন স্থানীয়ভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অভিভাবক, শিক্ষক এবং সাধারণ মানুষ সবাই একবাক্যে বলছেন— “বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করে দোষীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
প্রয়োজনে অভিযুক্ত শিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি উঠেছে। অনেকের মত, এমন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ না নিলে অন্য বিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের প্রতি ভয় ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়বে।