*মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি:**অগ্রগতি ও অন্তরায়*

_(Unity and Solidarity of the Muslim Ummah: Progress and Impediments)_

*১. ভূমিকা (Introduction):*

“তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০৩)!

এই আয়াত আমাদের শিক্ষা দেয় যে, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি শুধুমাত্র ধর্মীয় নির্দেশ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির মূল ভিত্তি। অথচ, বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ রাজনৈতিক বিভাজন, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং অভ্যন্তরীণ মতবিভেদের কারণে এক গভীর সংকটে নিপতিত। ঐক্য এবং সংহতি, দুটিই উম্মাহর জীবনীশক্তি। কিন্তু এই দুটি ক্ষেত্রেই আজ দেখা দিচ্ছে দুর্বলতা, যা উম্মাহর প্রকৃত শক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

*২. মুসলিম উম্মাহ: পরিচয় ও বাস্তবতা*

মুসলিম উম্মাহ এমন এক বৈশ্বিক সমাজ, যা ঈমান, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা এবং অভিন্ন চেতনার সেতুবন্ধনে সংযুক্ত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে উম্মাহর ধারণা গোত্র, বর্ণ বা জাতির ঊর্ধ্বে উঠে আসে, যেখানে ঈমান ছিল ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু।

ইতিহাসে মুসলিম উম্মাহ একদিকে স্বর্ণযুগের সাফল্য দেখেছে, আবার উপনিবেশ, বিভাজন এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের করাল ছায়াও দেখেছে। সমকালীন বিশ্বে রাজনৈতিক স্বার্থ, সীমারেখার কৃত্রিমতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের কারণে উম্মাহ তার প্রকৃত শক্তি হারাতে বসেছে।

*৩. ঐতিহাসিক পটভূমি (Historical Background):*

_৩.১ মদীনা সনদ:_ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় ‘মদীনা সনদ’ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক সহাবস্থানের মডেল তৈরি করে।

_৩.২ খিলাফতের যুগ:_ প্রথম চার খলিফার সময় রাজনৈতিক ঐক্য দৃঢ় ছিল। খিলাফত একক নেতৃত্বের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বকে শাসন করেছে। সেই ঐক্য জ্ঞান, বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কূটনীতিতে মুসলিমদের শ্রেষ্ঠত্ব এনে দেয়।

_৩.৩ উপনিবেশিক বিভাজন:_ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ মুসলিম বিশ্বকে কৃত্রিম সীমারেখায় বিভক্ত করে। Sykes-Picot চুক্তি (১৯১৬) মধ্যপ্রাচ্যকে বিভাজন করে, আর খিলাফত বিলুপ্তির পর মুসলিম বিশ্ব অসংখ্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ

*৪. রাজনৈতিক অন্তরায় (Political Impediments):*

_৪.১ উপনিবেশিক সীমারেখা ও রাষ্ট্রগঠন:_ কৃত্রিম সীমান্ত এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদ মুসলিম ঐক্যকে দুর্বল করেছে।

_৪.২ জাতীয়তাবাদ বনাম উম্মাহর পরিচয়:_ জাতীয়তাবাদের প্রবলতা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে।

_৪.৩ নেতৃত্বের সংকট:_ প্রজন্মগত নেতৃত্বের অভাব। ক্ষমতালিপ্সু শাসকশ্রেণি। বিদেশি হস্তক্ষেপে নেতৃত্ব পরিবর্তন।

_৪.৪ বিপরীত পররাষ্ট্রনীতি:_ মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলো বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ঐক্য প্রকাশ পেলেও, বাস্তবে পদক্ষেপ ভিন্ন।

_৪.৫ আন্তর্জাতিক শক্তির হস্তক্ষেপ:_ মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, ইয়েমেন ইত্যাদি অঞ্চলে বৈশ্বিক শক্তির প্রভাব ও “Proxy Battlefield” নীতি মুসলিম ঐক্যকে দুর্বল করছে।

*৫. মুসলিম উম্মাহর সংহতি (Solidarity of the Muslim Ummah):*

ঐক্য মূলত কাঠামোগত ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, কিন্তু সংহতি হচ্ছে উম্মাহর অন্তরাত্মার শক্তি। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, রাজনৈতিক বিভাজন থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতা উম্মাহকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শত্রু আক্রমণ কিংবা মানবিক সংকটে মুসলিম সমাজ একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে।

সংহতি কেবল মানবিক বা অর্থনৈতিক সহায়তায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি একে অপরের সম্মান রক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির বিনিময়, এবং ইসলামী ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের বিশ্বে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, সিরিয়া বা আফগান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মুসলিম উম্মাহর সংহতির পরীক্ষা। অথচ প্রায়ই দেখা যায়, সংহতি প্রকাশিত হয় মানবিক সাহায্যে, কিন্তু রাজনৈতিক পদক্ষেপে তা অনুপস্থিত।

_সংহতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন:_ পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতা বৃদ্ধি। প্রাতিষ্ঠানিক মানবিক সহায়তা। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উম্মাহর সমস্যা তুলে ধরা। অর্থনৈতিক সংহতি তহবিল (Islamic Solidarity Fund) গঠন।

আরও পউনঃ দাখিল পরীক্ষার ফলাফলে শীর্ষ স্থানে কাগতিয়া মাদ্রাসা

*৬. বর্তমান রাজনৈতিক অগ্রগতি (Current Political Progress):*

_৬.১ OIC-এর ভূমিকা:_ OIC ফিলিস্তিন ইস্যুতে একক অবস্থান নিলেও অভ্যন্তরীণ বিভাজনের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ প্রায়শই সীমিত।

_৬.২ আঞ্চলিক জোট:_ GCC, D-8, ECO প্রভৃতি আঞ্চলিক জোট কিছু সমন্বয় করছে, যদিও স্থায়িত্বের অভাব রয়েছে।

_৬.৩ কূটনৈতিক নতুন উদ্যোগ:_ সাম্প্রতিক সৌদি-ইরান পুনর্মিলন, তুরস্ক-আরব সম্পর্কের পুনর্গঠন মুসলিম ঐক্যের নতুন আশার আলো।

*৭. সুপারিশ (Recommendations):*

_৭.১ রাজনৈতিক ঐক্য:_ বড় ইস্যুতে (যেমন ফিলিস্তিন, ইয়েমেন) একক কূটনৈতিক নীতি গ্রহণ।

_৭.২ নেতৃত্বের সংস্কার:_ দূরদর্শী, ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব গড়ে তোলা; তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।

_৭.৩ সংহতি বৃদ্ধি:_ ইসলামী সংহতি তহবিল গঠন; ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে সহযোগিতা; প্রাতিষ্ঠানিক মানবিক সহযোগিতা বৃদ্ধি।

_৭.৪ আন্তর্জাতিক মিডিয়া:_ মুসলিম উম্মাহর সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ।

আরও পড়ুনঃ *জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লব: আইন, নীতি, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের আলোকে মনস্তাত্তিক এবং ভৌগোলিক বিশ্লেষণ*

*৮. উপসংহার (Conclusion):* “নিশ্চয়ই এই তোমাদের উম্মাহ একক উম্মাহ, আর আমি তোমাদের রব্ব, সুতরাং আমাকে ভয় কর।” (সূরা আল মু’মিনূন, ২৩:৫২)!

মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি ইতিহাসে কোনো কাল্পনিক বিষয় নয়। অতীতে উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ থেকে বিশ্বনেতৃত্ব করেছে। কিন্তু আজ রাজনৈতিক বিভাজন, নেতৃত্বের সংকট এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র উম্মাহকে দুর্বল করছে। রাজনৈতিক ঐক্য এবং আন্তরিক সংহতি—এই দুটো একসাথে না এলে মুসলিম উম্মাহ প্রকৃত শক্তি ফিরে পাবে না। ঐক্য ও সংহতিই মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

*উদ্ধৃতি (References):*

১. আল-কুরআনুল কারীম
২. আল-তাবারী, তারিখ উল উমাম ওয়াল মুলুক
৩. Bernard Lewis, The Middle East: A Brief History of the Last 2,000 Years
৪. John L. Esposito, Islam: The Straight Path
৫. OIC Official Documents
৬. David Fromkin, A Peace to End All Peace
৭. Vali Nasr, The Shia Revival

*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*।