*নবী জুলকিফল (আ.): দায়িত্বশীলতা*
*ও আত্মসংযমের এক মহান আদর্শ*
ভূমিকা: ইসলামের ইতিহাসে কিছু নবী আছেন যাঁদের সম্পর্কে কুরআনে সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর বার্তা এসেছে। তাঁদের একজন হলেন জুলকিফল (আ.)। ‘জুল-কিফল’ শব্দের অর্থ—দায়িত্ব বহনকারী বা যিনি দায়িত্ব পূর্ণ করেন। এই উপাধি থেকেই তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্ট হয়—তিনি ছিলেন অতুলনীয়ভাবে দায়িত্বশীল, আত্মসংযমী এবং ধৈর্যশীল।
*১. জুলকিফল (আ.)-এর পরিচিতি ও দাওয়াতি জীবন:* নবী আল-ইয়াসা (আ.) জুল-কিফল -এর অসাধারণ গুণের কারণে তাঁকে নিজের খলিফা নিযুক্ত করেন এবং আল্লাহ তাআলা জুল-কিফলকে নবুওয়াত দান করেন। তিনি আল-ইয়াসা (আ.)-এর দাওয়াতি মিশনকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নেন।
কুরআনের সূরা আম্বিয়া ও সূরা সাদে তাঁর নাম এসেছে প্রশংসাসূচকভাবে। আল্লাহর বাণী: “এবং স্মরণ করুন ইসমাঈল, ইদরীস ও জুলকিফলকে, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন ধৈর্যশীল; আমি তাঁদেরকে আমার রহমাতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম। তাঁরা ছিলেন সৎকর্মপরায়ণ-সালিহীন।’ (সূরা আম্বিয়া, ২১:৮৫-৮৬)। ‘আর স্মরণ করুন, ইসমাঈল, আল-ইয়াসা ও যুল-কিফ্লের কথা, আর এরা প্রত্যেকেই ছিলেন সজ্জনদের অন্তর্ভুক্ত’ (৩৮:৪৮)।
_জুলকিফল (আ.)-এর তিনটি মৌলিক গুণ:_ (ক). সিয়াম পালনকারী: তিনি নিয়মিত সিয়াম রাখতেন, যা আত্মসংযমের অনন্য নজির। (খ). রাত্রি জাগরণকারী: ইবাদতের মাধ্যমে রাত কাটানো ছিল তাঁর অভ্যাস, যা আত্মিক শুদ্ধির অনন্য পন্থা। (গ). ধৈর্যশীল (রাগান্বিত না হওয়া): তিনি কখনোই রাগ বা প্রতিশোধের পথে হাঁটেননি; বরং সবসময় সহিষ্ণু ছিলেন। তিনি ছিলেন সেইসব নবীগণের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা আল্লাহর পথে অবিরাম কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেছেন।
*২. জুলকিফল (আ.)-এর জীবনে পরীক্ষার অধ্যায়:* যদিও তাঁর জীবনের বিস্তারিত কাহিনী কুরআনে নেই, তবে ব্যাখ্যাকারীরা বলেন, তাঁকে একটি কঠিন দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল—একটি জাতিকে ন্যায়বিচার ও আল্লাহর পথে ফেরানো, যেখানে প্রতিনিয়ত অন্যায়, অবিচার ও ধৈর্যহীনতার প্রতিকূলতা ছিল।
এই দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত ধৈর্য, সংযম ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পালন করেন। জুলকিফল (আ.)-এর জীবনে শয়তানের ধোঁকা দেওয়ার একটি বিখ্যাত পরীক্ষা হাদীস ও ইতিহাসভিত্তিক বর্ণনায় এসেছে, বিশেষ করে ইমাম ইবন কাসীর (রাহি.)-এর প্রসিদ্ধ ইতিহাসগ্রন্থ “আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ”–তে (খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১০–২১১) বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। নিচে সংক্ষিপ্ত ও শিক্ষণীয়ভাবে তা উপস্থাপন করা হলো:
*৩. জুলকিফল (আ.)-এর জীবনে শয়তানের ধোঁকা পরীক্ষার কাহিনী:* ইবনে কাসীর (রাহি.) হাদীস ভিত্তিক বর্ণনায় বলেন: একবার নবী আল-ইয়াসা (আ.) তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে ঘোষণা দিলেন: “কে এমন ব্যক্তি আছেন, যিনি সারাদিন সিয়াম রাখবেন, সারারাত সালাতে কাটাবেন এবং কখনও রাগ করবেন না?” একজন যুবক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন: “আমি এই দায়িত্ব নিতে পারি।” তিনদিন একই ঘোষণা দেয়ার পর প্রতিবার ওই যুবকই উত্তর দেন। শেষে সেই আল-ইয়াসা (আ.) তাঁকে ওই কাজের দায়িত্ব দেন। আর, এই যুবকই ছিলেন জুলকিফল (আ.)।
_শয়তানের ধোঁকা ও পরীক্ষার কাহিনী:_ এই দায়িত্ব পালনের পর শয়তান জুলকিফল (আ.)-এর ধৈর্য ভাঙতে সংকল্প নেয়। সে এক বৃদ্ধ মানুষের রূপ ধারণ করে এসে তাঁর দরজায় এসে বিচার চায়, এবং দিনের প্রথম বেলায় বিচার গ্রহণের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও দুপুরে তাঁর নিদ্রার সময় এসে দরজায় ধাক্কা দেয়। জুলকিফল (আ.) তাঁকে বললেন: আমি তো দিনের দুপুরের বিশ্রামে থাকি, আপনি সকালে আসুন।
বৃদ্ধ বারবার দুপুর বেলায় এসে নিদ্রার বিরক্ত করতে থাকে। একদিন জুলকিফল (আ.) রাগান্বিত হওয়ার উপক্রম হলে নিজেকে সংযত রাখেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন—আজ আমি নিজেই দরজায় পাহারা দেব, কেউ যেন অনধিকার প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু সেই সময়, শয়তান একেবারে ঘরের ভেতরেই প্রবেশ করে উপস্থিত হয়। জুলকিফল (আ.) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, "তুমি ভেতরে কীভাবে ঢুকলে?" শয়তান তখন নিজের আসল রূপে ফিরে বলে, ‘আমি তো শয়তান, আর আমি চেয়েছিলাম তোমাকে রাগিয়ে তুলতে।
কিন্তু তুমি কখনোই রাগ করোনি। তাই আল্লাহ তোমার ধৈর্যের জন্য তোমাকে নবুয়ত দান করেছেন’। (উৎস: ইবনে কাসীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১০-২১১। এছাড়া কিছু হাদীস ও ইসরাইলি রেওয়ায়েতে কাহিনীটির অতিরঞ্জিত বিবরণও পাওয়া যায়, তবে উপরের অংশটি ইবনে কাসীর ও অন্যান্য ইতিহাসবিদগণের মূল গ্রহণযোগ্য রূপ)।
_নৈতিক শিক্ষা ও হিকমাহ:_ (ক). দায়িত্ব পালনে ধৈর্য ও সংযম অপরিহার্য। (খ). শয়তানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র—রাগ উত্তেজনা সৃষ্টি করা কিন্তু ঈমানী শক্তির নিকট সে পরাজিত হয়। (গ). নেতৃত্ব ও নবুয়তের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ভেতরের লড়াইয়ে জেতা জরুরি। আল্লাহর জন্য তাক্বওয়া ও আনুগত্যশীলতা হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য বড় অস্ত্র। (ঘ). আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নেন, কিন্তু ধৈর্যশীলদের সম্মানিত করেন। তাক্বওয়া ও ধৈর্য একত্রিত হলে মু’মিন সর্বদায় বিজয়ী হয়। (ঙ). ব্যক্তিগত ইবাদাত যেমন জরুরী, তেমনি জনগণের কল্যাণে সময় ব্যয় করাও একটি বড় ইবাদাত হিসাবে গণ্য।
*৪. কুরআনে জুলকিফল (আ.)-এর কাহিনী থেকে হিকমাহ ও নিদর্শন:* কুরআনে জুলকিফল (আ.)-এর নামের সঙ্গে "সাবেরিন" (ধৈর্যশীলগণ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী: “এবং স্মরণ করুন ইসমাঈল, ইদরীস ও জুলকিফলকে, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন ধৈর্যশীল; আমি তাঁদেরকে আমার রহমাতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম। তাঁরা ছিলেন সৎকর্মপরায়ণ-সালিহীন।
’(সূরা আম্বিয়া, ২১:৮৫-৮৬)। আল্লাহ বলেন: "আর স্মরণ করুন ইসমাঈল, ইদরীস ও জুলকিফলকে; এরা সবাই ছিলেন ধৈর্যশীল। আমি তাদেরকে আমার অনুগ্রহে অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম; নিশ্চয়ই তারা ছিল সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।" (সূরা সাদ, ৩৮:৪৮)। এখানে তিনটি মূল বার্তা এসেছে: (ক). সত্যনিষ্ঠা ও সৎকর্ম; (খ). আল্লাহর অনুগ্রহের যোগ্যতা অর্জন; এবং (গ). ধৈর্য ও সংযমের আদর্শ।
*৫. দায়িত্ব পালনে জুলকিফল (আ.)-এর হিকমাহ:* "জুলকিফল" উপাধি নিজেই এক দার্শনিক প্রতীক। তাঁর জীবন দেখায়, নেতৃত্ব মানেই শক্তি নয়, বরং তা হলো দায়িত্বের ভার, ন্যায়বিচার, সংযম এবং রাগ ও প্রতিশোধের উপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা।
*৬. তাঁর জীবন থেকে নির্দিষ্ট নিদর্শন ও তার হিকমাহ বিশ্লেষণ:* যাঁরা দায়িত্বের ভার গ্রহণ করেন, তাঁদের প্রয়োজন হয়, (ক). আত্মসংযম (Self-restraint); (খ). দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা (Clarity of vision); এবং রাগ বা আবেগের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ( Complete control over anger and emotions)। জুলকিফল (আ.) এসব গুণে উত্তীর্ণ হয়ে নেতৃত্বে ন্যায়ের মাপকাঠি স্থাপন করেন।
*৭. হাদিসে জুলকিফল (আ.)-এর আলোচনা:* যদিও হাদিসে তাঁর জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা খুব বেশি নেই, তবে কিছু বর্ণনায় বলা হয়, তিনি এমন এক জাতিকে শাসন করতেন, যারা দিনে গোমরাহী করত, আর রাতে ঈমান দেখাত। তিনি ধৈর্যের সঙ্গে তাঁদেরকে সত্যের পথে ফিরিয়ে আনেন।
(তাফসীর আত-তাবারী এবং তাফসীর ইবনে কাসীর: আসার ও ইতিহাসভিত্তিক বর্ণনা)। এই বর্ণনা সহীহ হাদীস হিসেবে নয়, বরং এটি ইতিহাস ও তাফসীর গ্রন্থে উল্লিখিত একটি বর্ণনা, যা শিক্ষণীয় হলেও সরাসরি হাদীস দাবি করা যায় না। তবে এর নৈতিক শিক্ষা ও হিকমাহ গ্রহণযোগ্য।
*৮. উপসংহার:* জুলকিফল (আ.) আমাদের শিক্ষা দেন—দায়িত্ব গ্রহণ মানেই ক্ষমতা নয়, বরং দায়িত্ব পালন এক কঠিন আমানত। একজন প্রকৃত নেতা রাত্রির নিঃশব্দে আল্লাহর সামনে নত হয়ে আত্মিক শক্তি অর্জন করেন এবং দিনের আলোর সমাজে ধৈর্য, সংযম ও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে উঠেন। জুলকিফল (আ.)-এর জীবন আজকের মুসলিম নেতৃত্ব ও সমাজের জন্য এক উজ্জ্বল আদর্শ। দায়িত্বশীলতা, রাগ নিয়ন্ত্রণ, সিয়াম ও তাহাজ্জুদের মাধ্যমে নিজেকে গঠন করাই হোক আমাদের পথচলা।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ০২-০৭-২৫)।
প্রধান উপদেষ্টাঃ ফরহাদ মাজহার
উপদেষ্টাঃ এস,এম নজরুল ইসলাম ভুইয়ামোঃ আমিনুল ইসলাম,
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আবুল হাসেম,
সহঃসম্পাদকঃ আলী নওয়াব খোকন,
বার্তা সম্পাদকঃ ইয়াছিন আরাফাত,
সহকারী বার্তা সম্পাদকঃ এম, আসমত আলী মিসু,
সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদকঃ আসাদুজ্জামান খান মুকুল,
www.dainikbanglarsangbad.com
ইমেইলঃ dainikbanglarsangbad490@gmail.com
প্রধান কার্যলয়ঃ বাড়ি নং ৩৫, রোড নং ৪, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইলঃ01736091515, 01716698621
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Copyright © 2025 dainikbanglarsangbad.com. All rights reserved.