ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*১৯৪৭: প্রজা থেকে নাগরিক হওয়ার ইতিহাস:*
_(পূর্ববাংলার মুসলমানদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের ইতিহাস)_
*সারসংক্ষেপ (Abstract):* বাংলার মুসলমানরা দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসন ও জমিদারি প্রথার অধীনে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত ছিল। শিক্ষা, প্রশাসন এবং সামাজিক মর্যাদায় তারা ছিল পিছিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের অশুচি হিসেবে গণ্য করা হতো; এমনকি নামকরণের অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কেবল একটি রাষ্ট্র সৃষ্টিই নয়, বরং মুসলমানদের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের সূচনা। এ প্রবন্ধে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, পূর্ববাংলার মুসলমানদের অবস্থা এবং পাকিস্তান আন্দোলনের তাৎপর্য আলোচিত হয়েছে।
_ভূমিকা:_ ইতিহাস কেবল রাজনৈতিক সীমানা বিভাজনের কাহিনি নয়; এটি মানুষের পরিচয়, অধিকার ও মর্যাদা পুনরুদ্ধারের দলিল। পূর্ববাংলার মুসলমানরা একসময় ছিল প্রজা যাদের শিক্ষা, নাম, পথচলা, সবকিছু জমিদারের দয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন তাদের জন্য নাগরিকত্ব ও আত্মমর্যাদার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
*মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা: ১৯৪৭ পূর্ব*
_জমিদারি প্রথা ও অবমাননা:_ জমিদারের সামনে মুসলমান প্রজাদের দাঁড়াতে হতো দশ হাত দূরে। মুসলমান সন্তানদের নাম রাখার অধিকার ছিল না; জমিদার তার নিজের ইচ্ছায় নাম দিতেন (যেমন “গোপাল, রঘুনাথ”)।
আবুল মনসুর আহমদ (আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর) বর্ণনা করেছেন, কিভাবে সামান্য “বেয়াদবির” কারণে তাঁর বাবাকে জমিদারের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল।
*শিক্ষায় বঞ্চনা:*
মুসলমান সন্তানদের অনেক স্কুলে ভর্তি করা হতো না। ভর্তি হলেও তারা “অশুচি” বিবেচিত হয়ে পৃথকভাবে বসত। ঐতিহাসিক রিচার্ড এম. ইটন (The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1993) দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক যুগে মুসলমানরা কৃষিজীবী হলেও আধুনিক শিক্ষায় পিছিয়ে ছিল।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক ঢাকা-৪ আসনের উন্নয়নে পরিবর্তনের অঙ্গীকার সৈয়দ জয়নুল আবেদীনের
*পাকিস্তান আন্দোলনের তাৎপর্য:*
_রাজনৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি:_ ১৯০৬: নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। ১৯৪০: লাহোর প্রস্তাব—শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের প্রস্তাবিত, যা মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৯৪৭: কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানের জন্ম।
_মর্যাদা পুনরুদ্ধারের সূচনা:_ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলমানরা শিক্ষা ও প্রশাসনে প্রবেশাধিকার পেতে শুরু করে।নাটোরে ম্যাজিস্ট্রেট কাজী নাজির প্রথমবার একজন মুসলমান শিশুর নাম রাখেন “আব্দুর রহমান”—এটি কেবল নামকরণ নয়, বরং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। মুসলমান সন্তানরা প্রথমবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার অধিকার পায়।
*সংগ্রামের ধারাবাহিকতা:*
_বিদ্রোহ ও আন্দোলন:_ তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া, মজনু শাহ প্রমুখ নেতারা জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তাদের রক্তে পদ্মা ও বুড়িগঙ্গা লাল হয়েছিল; তাদের আন্দোলন পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।
_১৯৪৭ পরবর্তী ধারা:_ ১৯৫২: ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত মর্যাদার দাবি। ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা। ২০২৪: নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম।
*ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ:*
১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন কেবল একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়; এটি ছিল মানুষ হিসাবে পরিচয় ও মর্যাদার পুনর্জন্ম। পূর্ববাংলার মুসলমানরা প্রজা থেকে নাগরিকে পরিণত হয়। এর প্রমাণ:
(ক). শিক্ষা অধিকার: মুসলমান সন্তানরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। (খ). নামকরণের অধিকার: জমিদারের ইচ্ছার পরিবর্তে অভিভাবকের ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হয়। (গ). সামাজিক মর্যাদা: মুসলমান আর “অশুচি প্রজা” নয়, বরং সমান নাগরিক।
তবে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরও সমস্যার অবসান হয়নি। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে নতুন সংগ্রাম শুরু হয়, যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম দেয়। তবুও ১৯৪৭ ছিল সেই প্রথম ভোর, যা নাগরিকত্বের
ভিত্তি স্থাপন করে।
*প্রজা থেকে নাগরিক: আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দর্শন ও ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ*
প্রজা থেকে নাগরিক হয়ে ওঠা কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং এক গভীর সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক রূপান্তর। আইন ও নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিক মানে হলো রাষ্ট্রের অংশীদার, যিনি কেবল শাসিত নন, বরং শাসনের নৈতিক ও সাংবিধানিক বৈধতার উৎস। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এই রূপান্তরকে আরও শক্তিশালী করে, কারণ নাগরিক তার অধিকার ভোগের পাশাপাশি কর্তব্য পালনেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। দর্শনের আলোকে, এটি আত্মপরিচয়ের এক নতুন সংজ্ঞা, মানুষ আর নিছক প্রজাপ্রথার অধীন নয়, বরং স্বাধীন সত্তা হিসেবে রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।
আরও পড়ুনঃ খালেদা জিয়ার জন্মদিনে তুরাগ থানা বিএনপির সদস্য সাগরের আয়োজনে দোয়া,মিলাদ মাহফিল ও তবারক বিতরণ
ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাগরিকত্বের এই ধারণা আরও তাৎপর্যপূর্ণ। একটি রাষ্ট্র যখন তার প্রজাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। গণতান্ত্রিক শাসন, জবাবদিহিতা, এবং মানবাধিকার রক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্র কেবল অভ্যন্তরীণ স্থিতি নয়, বরং বৈশ্বিক অঙ্গনেও শক্ত অবস্থান তৈরি করে। তাই ১৯৪৭ সালে প্রজা থেকে নাগরিক হয়ে ওঠা মানবসভ্যতার এক অনন্য অর্জন, যা আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দর্শন ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সমন্বয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করে।
*উপসংহার:*
১৪ আগস্ট ১৯৪৭ কেবল পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মদিন নয়; এটি পূর্ববাংলার মুসলমানদের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের দিন। এই দিন থেকে তারা প্রজা থেকে নাগরিক হলো, অধিকার দাবি করতে শিখল, নিজের নাম ও শিক্ষা ফিরে পেল।
আজ আমরা যখন স্বাধীনতার সুফল ভোগ করি, তখন ১৯৪৭-এর ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। এটি আমাদের প্রথম আজাদীর দিন, যেদিন দাসত্ব ভেঙে মর্যাদার আলো ফুটেছিল।
*সূত্রসমূহ (References):*
1.আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর, প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯।
2.Eaton, Richard M., The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760, University of California Press, 1993.
3.Jalal, Ayesha, The Sole Spokesman: Jinnah, the Muslim League and the Demand for Pakistan, Cambridge University Press, 1985.
4.Ahmed, Rafiuddin, The Bengal Muslims, 1871–1906: A Quest for Identity, Oxford University Press, 1981.
5.Rahim, Abdur, Muslim Society and Politics in Bengal, 1757–1947, Dhaka University Press, 1981.
Dr. M. G. Mostafa Musa
প্রধান উপদেষ্টাঃ ফরহাদ মাজহার
উপদেষ্টাঃ এস,এম নজরুল ইসলাম ভুইয়া
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আবুল হাসেম
উপ সম্পাদকঃ এম, আসমত আলী মিসু
সহঃসম্পাদকঃ আলী নওয়াব খোকন
বার্তা সম্পাদকঃ ইয়াছিন আরাফাত
সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদকঃ আসাদুজ্জামান খান মুকুল
www.dainikbanglarsangbad.com
ইমেইলঃ dainikbanglarsangbad490@gmail.com
প্রধান কার্যলয়ঃ বাড়ি নং ৩৫, রোড নং-৪, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইলঃ01736-091515, 01716-698621
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Copyright © 2025 dainikbanglarsangbad.com. All rights reserved.