ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*বিজ্ঞান: মানবতার কল্যাণে নাকি ধ্বংসে*
*১. ভূমিকা:* মানুষের ইতিহাসে বিজ্ঞান এমন এক শক্তি, যা সভ্যতাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছে। বিজ্ঞানের হাত ধরে মানুষ রোগের চিকিৎসা খুঁজে পেয়েছে, দূরত্বকে করেছে সংকুচিত, জীবনকে করেছে সহজতর। অথচ, এ বিজ্ঞানই আবার পরিণত হচ্ছে ভয়ঙ্কর ধ্বংসের অস্ত্রে।
একদিকে বিজ্ঞান মানুষকে সুস্থ, সুখী ও উন্নত জীবন দিচ্ছে, অন্যদিকে তারই মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে পরমাণু বোমা, মিসাইল, রাসায়নিক অস্ত্র, যা পুরো মানবসভ্যতাকে নিমিষে ধ্বংস করতে পারে। তাই আজ প্রশ্ন উঠে— বিজ্ঞান কি কেবল মানবতার রক্ষক, নাকি সে হয়ে উঠছে ধ্বংসের দূত?
*মানবতার কল্যাণ হিসেবে বিজ্ঞান:*
বিজ্ঞান মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় সুফল এনে দিয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে আজ অনেক দুরারোগ্য রোগও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসেছে। টিকা, অ্যান্টিবায়োটিক, উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে মানুষ এখন মুহূর্তেই বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের খবর জানছে, শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে, জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুতগতিতে।
কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কারণে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, খাদ্যাভাব অনেকাংশেই দূর হয়েছে। পরিবেশ রক্ষার জন্যও বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এইসব অবদান প্রমাণ করে, বিজ্ঞান মানুষের মঙ্গলেই কাজ করতে পারে।
*মানবতার ধ্বংস হিসেবে বিজ্ঞান:*
অন্যদিকে, বিজ্ঞানের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র। পারমাণবিক বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্র এমন এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা, যা মুহূর্তেই লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসলীলা আজও মানুষের মনকে শিউরে তোলে।
অস্ত্র ব্যবসা ও যুদ্ধনীতির পেছনে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করছে কিছু রাষ্ট্র ও গোষ্ঠী। ক্ষমতা ও আধিপত্যের লড়াইতে বিজ্ঞান হয়ে উঠছে ধ্বংসের হাতিয়ার। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-র ক্ষেত্রেও শঙ্কা দেখা দিয়েছে, যদি এটি অনিয়ন্ত্রিত বা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। তাই বিজ্ঞান যেমন সৃষ্টির, তেমনি ধ্বংসের সম্ভাবনা বহন করছে।
*আইন, নীতি, নৈতিকতা, এবং মূল্যবোধের আলোকে বিজ্ঞান (রক্ষক নাকি ধ্বংস)?*
বিজ্ঞানকে মানবতার রক্ষক বা ধ্বংসের দূত হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে আইন, নীতি, নৈতিকতা এবং সমাজের মূল্যবোধ। যদি কঠোর আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে মারণাস্ত্রের সীমা নির্ধারণ করা যায়, তবে বিজ্ঞান ধ্বংসের পথে ব্যবহৃত হওয়া অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব। নীতি এবং নৈতিকতার শিক্ষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়— বিজ্ঞানকে যেন মানবকল্যাণের বাইরে ব্যবহার না করা হয়।
বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের দায়িত্ব, তারা যেন তাদের গবেষণার উদ্দেশ্য সবসময় মানবিক এবং নৈতিক মানদণ্ডের মধ্যে রাখে। পাশাপাশি, সমাজের সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে, যেন তারা বিজ্ঞানকে কেবল সুবিধা নেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে দেখে, ধ্বংসের জন্য নয়। তাই আইন, নীতি, নৈতিকতা আর মূল্যবোধই বিজ্ঞানের সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারে— রক্ষকের পথে, ধ্বংসের পথে নয়।
আরও পড়ুনঃ নাসিরনগরের এক মহিলা একসঙ্গে তিন ছেলের জন্ম দিয়েছন
*অতীত ও বর্তমান যুদ্ধ এবং বিজ্ঞানের ব্যবহার: আইন, নীতি, নৈতিকতার প্রশ্ন*
অতীতে যেসব যুদ্ধ হয়েছে, যেমন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সেসব যুদ্ধেই দেখা গেছে বিজ্ঞানের ভয়ঙ্কর ব্যবহার। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে রাসায়নিক অস্ত্রের নির্মম প্রয়োগ, মানুষের প্রাণহানি এবং বিপুল সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞ— কোনোটিই বিজ্ঞানের কল্যাণ নয়।
বর্তমানেও দেখা যাচ্ছে, ড্রোন ও বিমান আক্রমণ, সাইবার যুদ্ধ, মিসাইল হামলা, জৈব অস্ত্রের আশঙ্কা— এসবই বিজ্ঞানের ফসল, যা ক্ষমতালিপ্সু রাষ্ট্রনায়কদের খামখেয়ালী সিদ্ধান্তের কারণে মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের কি কোনো বৈধতা আছে? আইন, নীতি, নৈতিকতা বা মূল্যবোধ কি অনুমোদন করে কোটি কোটি মানুষের জীবন নিয়ে এমন খেলাকে? আন্তর্জাতিক আইন এবং যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত নানা সনদ থাকলেও বাস্তবে তা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়।
ক্ষমতালিপ্সু শাসকরা নিজের স্বার্থ রক্ষায় বিজ্ঞানকে জিম্মি করে রাখে। ফলে বিজ্ঞান হয়ে পড়ে বিশ্ব স্বৈরাচারের হাতিয়ার। যুগে যুগে মানুষ তাই এই রাষ্ট্রনায়কদের ধিক্কার জানিয়েছে, কারণ তারা বিজ্ঞানের কল্যাণমূলক দিককে আড়ালে ফেলে ধ্বংসের পথ বেছে নেয়।
সুতরাং, মানব রচিত আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সীমাবদ্ধতা আমাদের বোঝায় যে, আল্লাহ প্রদত্ত সার্বজনীন নীতি ও মূল্যবোধ ছাড়া বিজ্ঞান কখনোই নিরাপদ ও কল্যাণকর হতে পারে না।
*মানবিক আইন, নীতি ও নৈতিকতার উৎস: ভৌগলিক না ঐশ্বরিক?*
মানুষ নিজেই প্রায়ই বিভ্রান্ত হয় কোনটি তার জন্য ভালো, আর কোনটি মন্দ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্র্যাকটিস একেক যুগে একেক মানুষের কাছে ভিন্নভাবে এসেছে। যে কারণে মানব রচিত আইন ও নীতিমালা বারবার পরিবর্তিত হয়, প্রায়শই স্বার্থের দ্বন্দ্বে বা ক্ষমতার লড়াইয়ে। অথচ, ঐশী উৎস থেকে প্রাপ্ত আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন নবী ও রাসূলদের মাধ্যমে এসেছে এবং এগুলোই সার্বজনীন, শাশ্বত এবং সকল যুগ ও সকল এলাকার মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
আল্লাহ প্রদত্ত এই নীতি ও আইন মানুষকে সত্যিকার ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও মানবকল্যাণের পথে পরিচালিত করে। মানব রচিত সীমিত জ্ঞান ও স্বার্থ দ্বারা প্রণীত আইন যতই আধুনিক হোক, তাতে চূড়ান্ত মুক্তি নেই। তাই বিজ্ঞানকে সত্যিকার অর্থে মানবতার রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন আল্লাহর দেওয়া নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গ্রহণ করা এবং তা প্র্যাকটিস করা। একমাত্র তখনই বিজ্ঞান হবে কল্যাণের হাতিয়ার, ধ্বংসের নয়।
*উপসংহার:* সত্যি বলতে, বিজ্ঞান নিজেই ভালো বা খারাপ নয়। এর ব্যবহার নির্ভর করে মানুষের বিবেক, নীতি ও উদ্দেশ্যের উপর। বিজ্ঞান হতে পারে মানবতার রক্ষক, যদি তা মানবকল্যাণে কাজে লাগে; আবার হতে পারে ধ্বংসের দূত, যদি তা ক্ষমতার লালসায়, যুদ্ধ ও নিপীড়নে ব্যবহৃত হয়।
অতীতের ভয়াবহ যুদ্ধ এবং বর্তমানের অস্ত্র প্রতিযোগিতা আমাদের শিক্ষা দেয়, মানব রচিত আইন, নীতি, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ যথেষ্ট নয় বিজ্ঞানকে সঠিক পথে রাখতে।
তাই প্রয়োজন ঐশী উৎস থেকে প্রাপ্ত আল্লাহর প্রদত্ত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে গ্রহণ ও প্র্যাকটিস করা, যাতে বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণেই ব্যবহৃত হয় এবং সভ্যতা এগিয়ে যায় আলোর দিকে, অন্ধকারের দিকে নয়। বিজ্ঞান আমাদের হাতে— তাকে কীভাবে ব্যবহার করব, সেটাই আসল প্রশ্ন।
Dr. M. G. Mostafa Musa
Date: 03-07-25
প্রধান উপদেষ্টাঃ ফরহাদ মাজহার
উপদেষ্টাঃ এস,এম নজরুল ইসলাম ভুইয়ামোঃ আমিনুল ইসলাম,
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আবুল হাসেম,
সহঃসম্পাদকঃ আলী নওয়াব খোকন,
বার্তা সম্পাদকঃ ইয়াছিন আরাফাত,
সহকারী বার্তা সম্পাদকঃ এম, আসমত আলী মিসু,
সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদকঃ আসাদুজ্জামান খান মুকুল,
www.dainikbanglarsangbad.com
ইমেইলঃ dainikbanglarsangbad490@gmail.com
প্রধান কার্যলয়ঃ বাড়ি নং ৩৫, রোড নং ৪, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইলঃ01736091515, 01716698621
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Copyright © 2025 dainikbanglarsangbad.com. All rights reserved.