ডেস্ক রিপোর্টঃ
২০০১ সালে ২৩ ‘তারকা সন্ত্রাসীর’ তালিকা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। পরে তারা ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই তকমা কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছর চাঁদাবাজি করার অভিযোগ আছে এদের অনেকের বিরুদ্ধে। কারাগারে অথবা বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের নামে নিয়ন্ত্রণ হয় অপরাধ জগৎ।
সেই তারকা সন্ত্রাসীদের মধ্যে বহুল আলোচিত সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও মোল্লা মাসুদ সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় সোনার বাংলা মসজিদের পাশে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ধরা হয় তাদের। এর আগে রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের দুই সহযোগী আরাফাত ও গাড়িচালক শরীফকে। অপরাধ জগতে সুব্রত বাইনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত শিষ্য হিসেবে পরিচিত মোল্লা মাসুদ।
সেনাসদস্যরা ভোরে ভবনটি ঘিরে ফেলেন। এরপর তিন ঘণ্টাব্যাপী চলে অভিযান। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি ও একটি স্যাটেলাইট ফোন।
দেড় মাস আগে বাসাটি ভাড়া নেন স্থানীয় এক দম্পতি। তারা অনলাইনে পোশাক কেনাবেচার কথা বলে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে ওই বাসা থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্র সমকালকে বলছে, কুষ্টিয়ায় বাসা ভাড়া করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে সহযোগিতা করেন হেলাল ও হাফিজুল নামের দুই ভাই। তারা একসময় সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকতেন। আগে থেকেই সুব্রতর সঙ্গে তাদের পরিচয়। এর আগে সুব্রত খুলনা ও যশোরে গোপন আস্তানায় ছিলেন। গত ডিসেম্বরে সুব্রত একবার তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়ার জোবারপাড় গ্রামে গিয়েছেন এবং এক রাত থাকেন বলে গোয়েন্দারা জানতে পারেন।
সূত্রের দাবি, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভারত থেকে দেশে ফেরেন সুব্রত বাইন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন তিনি। তাঁর নামে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি আছে। অনেক আগেই নাম পরিবর্তন করে তিনি ভারতে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। আর দিন দশেক আগে দেশে আসেন মোল্লা মাসুদ। মাসুদও সরকারের ঘোষিত তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের একজন।
দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা
দুই সন্ত্রাসীসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় গতকাল বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা ও পরিকল্পনায় তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, মঙ্গলবার ভোর ৫টা থেকে শুরু হওয়া কুষ্টিয়া ও হাতিরঝিলে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে ৪৬ স্বতন্ত্র ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের একটি ইউনিট গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সফলভাবে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং তাদের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যা, চাঁদাবাজি এবং নাশকতা চালিয়ে আসছিল। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ তালিকাভুক্ত ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী দলের অন্যতম নেতা এবং সেভেন স্টার চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি বলেন, এ অভিযান ছিল দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা ও পরিকল্পনার ফসল। অপারেশনটি অত্যন্ত নিপুণভাবে ক্ষয়ক্ষতি বা সংঘর্ষ ছাড়াই পরিচালিত হয়, যা সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় ও সহায়তা দিয়েছে সেনাসদরের সামরিক অপারেশন পরিদপ্তর, ৫৫ পদাতিক ডিভিশন, ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড, ৭১ মেকানাইজ ব্রিগেড ও এনএসআই।
আইএসপিআর পরিচালক বলেন, সেনাবাহিনী প্রধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং জনগণের জানমালের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে।
দেড় মাস আগে বাসা ভাড়া
মঙ্গলবার ভোর ৫টা। তখনও অন্ধকার চারদিকে। হঠাৎ হাতুড়ির শব্দ ও মসজিদের মাইকের শব্দে ঘুম ভাঙে। আশপাশের লোকজন দেখে সেনাবাহিনীর সদস্যরা চারদিকে অবস্থান নিয়েছেন। মাইকে বলতে শোনা যায়, ‘যে যেখানে আছেন, সেখানেই অবস্থান করেন।’ অনেকে আশপাশের বাসার জানালা ও ছাদ থেকে ঘটনা দেখতে থাকেন। ভোরের আলো ফোটার পর থেকে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকার লোকজন একটু একটু করে বুঝতে পারেন ‘বড় ধরনের কোনো অপরাধী’ সেনা অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে।
তিনতলা ভবনটি ভাড়া নেন ছাত্ররা। সেখানে তারা মেস করে থাকেন। মেসের বাসিন্দা এক ছাত্র বলেন, মাস দেড়েক আগে পেছনের বাড়ির বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী মিনারা খাতুন হীরা নিচতলার ফ্ল্যাট ভাড়া চান। অনলাইনে পোশাক কেনাবেচার জন্য সেখানে পোশাক রাখা হবে। আর কিছু লোকজনও থাকবে। এরপর হেলাল উদ্দিন এই ভবনের সামনে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা বসান। ক্যামেরার সংযোগ পেছনে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। এর কয়েক দিন পর এই বাসায় মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি আসেন। তিনি খুব একটা বের হতেন না। ২০ থেকে ২৫ দিন এক নারীকে নিচতলার ওই ফ্ল্যাটে দেখতে পান ছাত্ররা। ১০-১২ দিন ধরে এই ভবনের সামনে একটি লাল রঙের প্রাইভেটকার এসে দাঁড়াত। কিছু লোকের যাতায়াত ছিল। বাসাটিতে কোনো রান্না হতো না। বাইরে থেকে খাবার আনা হতো। পাঁচ-ছয় দিন আগে আসরের নামাজ পড়তে বের হওয়ার সময় দেখেন নিচতলার ওই ফ্ল্যাটের দরজা খোলা এবং সেখানে দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া ওই দাড়িওয়ালা ব্যক্তিই সুব্রত বাইন বলে এখন জানা গেছে।
ভবনটির মালিক মীর মহিউদ্দিন। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা বিএনপি সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী মেসের একজন ছাত্র বলেন, ‘ভোর ৫টার দিকে সেনাবাহিনী সদস্যরা মেসে ঢুকে প্রথমে ওপরের ফ্ল্যাটে যায়। এর পর আমাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে। আমাদের রুমে তারাও তল্লাশি চালায়। দাড়িওয়ালা কেউ এ বাসায় থাকে কিনা, জানতে চায়। আমরা বলি, সবাই ছাত্র। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমরা বলি, নিচতলায় কয়েকজন থাকে, তাদের আমরা চিনি না। এর পর সেনাসদস্যরা নিচতলার বাসায় দরজায় নক করলে ভেতর থেকে না খোলায় বাইরে থেকে দরজা ভেঙে ফেলা হয়।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, যার মাধ্যমে বাসাটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, সেই হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে মামলা ছিল। তিনি এক যুগ দুবাই ছিলেন। দেশে আসেন কয়েক বছর আগে। এর পর শহরের কাটাইখানা মোড়ে মোটর পার্টসের ব্যবসা শুরু করেন।
আলোচিত সন্ত্রাসীরা কে কোথায়
গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও অন্যান্য সূত্র থেকে জানা গেছে, আগস্টের পর কারাগার থেকে ছাড়া পান তারকা সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল, আরমান, সানজিদুল ইসলাম ইমন, টিটন ও কিলার আব্বাস। আর দেশে ফেরত আসেন সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, আমিন রসুল ও টোকাই সাগর। হঠাৎ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকার অপরাধ জগৎ।
সূত্র আরও বলছে, গ্রেপ্তার এড়াতে এরই মধ্যে দেশ ছাড়েন ইমন ও কিলার আব্বাস। তারকা সন্ত্রাসীদের মধ্যে বিকাশ ও তাঁর ভাই প্রকাশ বর্তমানে ফ্রান্সে। তানভীরুল ইসলাম জয় থাইল্যান্ডে ও কারওয়ান বাজারের আশিক, মশিউর রহমান কচি এবং গলাকাটা নাছির দেশের বাইরে আছেন বলে পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্র জানায়।
বিএনপি নেতা হত্যায় সুব্রতর অস্ত্র
মধ্য বাড্ডায় গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধন হত্যায় সুব্রত বাইনের গ্রুপের দুটি অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়। তাদের তথ্যমতে, সপ্তাহখানেক আগে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসেন সুব্রত। এর পর বাড্ডার একটি গাড়ির শোরুমে সহযোগী দীপু ও অন্তরের কাছে দুটি অস্ত্র দেন তিনি। ওই অস্ত্র সাধন হত্যায় ব্যবহার হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে মগবাজারে যুবদলকর্মী আরিফে হত্যায় সুব্রত গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার তথ্য মেলে। হত্যা মিশনে ভূমিকা রাখেন সাইদ ওরফে বড় সাইদ নামে এক ব্যক্তি। কয়েক দিন আগে তিনি কারাগার থেকে জামিনে বের হন।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আরেক সন্ত্রাসী মেহেদীর সঙ্গে সাইদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সম্প্রতি গুলশানে সুমন নামে এক ব্যক্তি খুন হন। ওই হত্যার পর সাইদ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে তিনি জামিন পান। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, রাজধানীতে সাম্প্রতিক যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তার পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হাত আছে।
মতিঝিল-গোপীবাগের ত্রাস হিসেবে পরিচিত মোল্লা মাসুদ একসময় আবু রাসেল মো. মাসুদ নাম ব্যবহার করতেন। ভারতের নাগরিক রিজিয়া সুলতানাকে বিয়ে করে দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করছিলেন। পরে কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস) তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ঢাকায় মোল্লা মাসুদের বিরুদ্ধে রয়েছে ৩০টির বেশি মামলা। এর মধ্যে রয়েছে মামুন হত্যা, পুরান ঢাকার মুরগি মিলন হত্যা, খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায় ট্রিপল মার্ডার।
এক্সেল বাবু গ্রেপ্তার
মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং চক্রের মদদদাতা হিসেবে পরিচিত ফরিদ আহমেদ বাবু ওরফে এক্সেল বাবুকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কথিত বিএনপি নেতা এক্সেল বাবু ‘কবজি কাটা’ গ্রুপের প্রধান আনোয়ারের আশ্রয়দাতা। দীর্ঘদিন ধরে এলাকাবাসী এক্সেল বাবু ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আসছিল।
তথ্য সুত্রঃ সমকাল
প্রধান উপদেষ্টাঃ ফরহাদ মাজহার
উপদেষ্টাঃ এস,এম নজরুল ইসলাম ভুইয়ামোঃ আমিনুল ইসলাম,
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আবুল হাসেম,
সহঃসম্পাদকঃ আলী নওয়াব খোকন,
বার্তা সম্পাদকঃ ইয়াছিন আরাফাত,
সহকারী বার্তা সম্পাদকঃ এম, আসমত আলী মিসু,
সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদকঃ আসাদুজ্জামান খান মুকুল,
www.dainikbanglarsangbad.com
ইমেইলঃ dainikbanglarsangbad490@gmail.com
প্রধান কার্যলয়ঃ বাড়ি নং ৩৫, রোড নং ৪, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইলঃ01736091515, 01716698621
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Copyright © 2025 dainikbanglarsangbad.com. All rights reserved.