ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে রাজতন্ত্র:*
*একটি পর্যালোচনা*
_আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দর্শন এবং রাষ্ট্রনীতির আলোকে বিশ্লেষণ। এতে ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দলিল, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও চিন্তাধারার বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।_
*১. ভূমিকা:* ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে ন্যায়, ইনসাফ, জবাবদিহিতা এবং কল্যাণের পথ দেখায়। কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী শাসনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের ওপর আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বস্তরে ইনসাফ ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। এই প্রেক্ষাপটে, ইতিহাস ও সমসাময়িক সমাজে প্রচলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনব্যবস্থা হলো রাজতন্ত্র, যেখানে নেতৃত্ব বংশানুক্রমিকভাবে হস্তান্তরিত হয়।
প্রশ্ন জাগে: ইসলাম কি রাজতন্ত্রকে বৈধ বলে গণ্য করে? এ প্রবন্ধে এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা হবে ইসলামি শরীয়াহ, নৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রনীতি এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
*২. ইসলামি শাসনব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো:*_২.১ তাওহীদ ও শাসনের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব:_ কুরআন ঘোষণা করে: "হুকুম একমাত্র আল্লাহরই" (সূরা ইউসুফ, ১২:৪০)! এর অর্থ, ইসলামি শাসনব্যবস্থা হতে হবে এমন একটি কাঠামো, যেখানে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব থাকবে আল্লাহর বিধানের এবং শাসক থাকবে একজন খাদেম বা আমানতদার হিসেবে।
_২.২ শুরা ও জবাবদিহিতা:_ কুরআনে বলা হয়েছে: "তাদের সব কাজ পরস্পরের পরামর্শের ভিত্তিতে হয়" (সূরা আশ-শূরা, ৪২:৩৮)!
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবন ও খিলাফায়ে রাশেদার আমলে আমরা দেখি, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে পরামর্শ, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা ছিল অপরিহার্য উপাদান।
আরও পড়ুনঃ রাজীবপুরে আওয়ামীলীগ নেতা গ্রেপ্তার
*৩. রাজতন্ত্র: সংজ্ঞা ও স্বরূপ:* _৩.১ রাজতন্ত্র (Monarchy):_ রাজতন্ত্র হলো একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসনক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে একজন রাজা বা সুলতানকে দেওয়া হয়। এতে 'শাসক' নির্বাচনে জনগণের কোন সুযোগ থাকে না; বরং এটি একটি বংশানুক্রমিক ব্যবস্থা।
_৩.২ মূল বৈশিষ্ট্য:_ (ক). বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব; (খ). একনায়কতান্ত্রিক বা কেন্দ্রিক শাসন; (গ). গণপরামর্শের সীমিত প্রয়োগ; এবং (ঘ). অধিকাংশ ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ঘাটতি।
*৪. ইসলামি আইন ও রাজতন্ত্র: কী বলে শরীয়াহ?*
_৪.১ ইসলামের রাষ্ট্রীয় দর্শন:_ ইসলামের রাষ্ট্রদর্শন চারটি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত: আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, শূরা (পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত), ইনসাফ (ন্যায়বিচার), এবং মসুলিয়ত (জবাবদিহিতা)। এই স্তম্ভগুলো শুধু আদর্শ নয়, বরং ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অপরিহার্য শর্ত। রাজতন্ত্র যদি এসব ভিত্তিকে উপেক্ষা করে, তবে তা কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং শরীয়াহ বিরুদ্ধ বলেই গণ্য হবে।
_৪.২ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রাজতন্ত্রের মূল্যায়ণ:_ ইমাম আল-মাওয়ার্দির 'আহকামুস সুলতানিয়্যাহ'–তে তিনি একটি শর্তসাপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, শাসকের মূল দায়িত্ব দ্বীন রক্ষা ও দুনিয়াবি কল্যাণ নিশ্চিত করা। তার বক্তব্যে এ কথার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, রাজতন্ত্র শর্ত সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য—যদি তা ইসলামী নীতিমালার বিরুদ্ধে না যায় এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে। একইভাবে ইবন খালদুন, ইবন তাইমিয়্যাহ এবং ইমাম গাযালীও বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, যেখানে বলা হচ্ছে, শাসনব্যবস্থা যদি আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা না করে এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তাহলে তা সহনীয় হতে পারে।
_৪.৩ রাজতন্ত্রের ব্যাপারে আপোসের চেষ্টা:_ তবে উপরোক্ত বক্তব্যগুলো প্রেক্ষাপটভিত্তিক এবং নিরপেক্ষ ছিল না। ওই সময় মুসলিম শাসকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একনায়কতান্ত্রিক ধারায় চলে গিয়েছিল, ফলে আলেমগণ হয়তো বিপরীত প্রতিক্রিয়া এড়াতে কিংবা অরাজকতা ঠেকাতে কিছুটা নমনীয় ভাষা প্রয়োগ করেছেন।
সুতরাং, আলেমদের এসব উক্তি ইসলামের মৌলিক রাষ্ট্রনৈতিক নীতির পরিপন্থী ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয় না, বরং তা ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে সাময়িক সহনশীলতা হিসেবেই ব্যাখ্যা করা উচিত। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা সর্বাবস্থায় ন্যায়ের শাসন, পরামর্শভিত্তিক প্রশাসন, সর্বোচ্চ জবাবদিহিতা এবং আল্লাহর বিধান অনুসরণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। অতীত ও বর্তমান রাজতন্ত্র ইসলামের এই মূল নীতিএগুলোকে ক্ষুণ্ণ করেছে এবং করে চলেছে, তাই ইসলামে রাজতন্ত্র পরিত্যাজ্য।
_৪.৪ একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস:_ “যে ব্যক্তি তোমাদেরকে শাসন করবে, সে যদি আল্লাহর আইন অনুযায়ী চলে, তবে তাকে অনুসরণ করো; আর যদি অন্যায় করে, তবে তার অন্যায়ের দায় তার উপর থাকবে।” (মুসলিম)
এই হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে, একজন শাসকের আচার-আচরণ ও নীতিনিষ্ঠতাই মুখ্য। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের মতো শাসনব্যবস্থা শাসককে সহজেই নীতিভ্রষ্টতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ফলে ইসলামে এমন একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যেখানে শাসকের আচরণ ও সিদ্ধান্ত পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং নীতি-নৈতকতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
আরও পড়ুনঃ “ভলান্টিয়ার ফর সেনবাগ” কাদরা টু গোরকাটায় বৃক্ষরোপন অনুষ্ঠিত
*৫. নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন:* _৫.১ ন্যায় ও যোগ্যতা:_ কুরআন নির্দেশ করে: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার-মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায় ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদিগকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্ট্রা"। (সূরা নিসা, ৪:৫৮)!
রাজতন্ত্রে বংশের ভিত্তিতে নেতৃত্বের উত্তরাধিকার চালু থাকে, যা অনেক সময় যোগ্যতার সাথে সাংঘর্ষিক হয়। অথচ ইসলামে নেতৃত্বের যোগ্যতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং আল্লাহভীতির মাফকাঠি সর্বোচ্চ।
_৫.২ শাসকের চরিত্র:_ ইসলামে শাসকের ব্যক্তিত্ব ও নৈতিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো রাজা যদি ন্যায়পরায়ণ, পরামর্শগ্রহণে আগ্রহী এবং শরীয়াহনিষ্ঠ হয়, তবে তার শাসন ক্ষতিকর নাও হতে পারে। তবে ইতিহাস ও বাস্তবতায় দেখা যায় যে, অধিকাংশ রাজতন্ত্রেই স্বৈরতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, বিলাসিতা ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা প্রকটভাবে বিরাজমান। এসব ব্যর্থ অভিজ্ঞতার পরেও যদি "যদি" শব্দ জুড়ে রাজতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে সেই মানসিকতা হবে ইসলামের মূল দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক।
*৬. রাষ্ট্রনীতি ও দর্শনের আলোকে রাজতন্ত্র* _ইসলামের রাষ্ট্রনীতি মূলত চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে:_(ক). আল্লাহর সার্বভৌমত্ব; (খ). শূরা বা পরামর্শ; (গ). ইনসাফ বা ন্যায়বিচার; এবং (ঘ). মসুলিয়ত বা জবাবদিহিতা।
অতীতের রাজতন্ত্র কখনোই এই চারটি ভিত্তি রক্ষা করতে পারে নি। বর্তমানের রাজতন্ত্র বাস্তবে এই মূল্যবোধগুলো রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ দুদকের জালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক ডজন প্রকৌশলী!
*৭. সমসাময়িক প্রেক্ষাপট:* আজকের অনেক মুসলিম দেশে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত—যেমন সৌদি আরব, মরক্কো, জর্ডান। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শরীয়াহর কিছু বিধান মানে, কেউ আবার রাজতান্ত্রিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে।
এই রাজতন্ত্রগুলো যেহেতু ইনসাফ, যোগ্যতা, আল্লাহর বিধান ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় না, তাই ইসলামিক হতে পারে না। আর একারণে 'রাজতন্ত' হল শুধুই ইসলাম নামধারী এক ‘বিপরীত দর্শন’।
*৮. তুলনামূলক বিশ্লেষণ:* ইসলামী শাসনব্যবস্থা যোগ্যতা, পরামর্শ, জবাবদিহিতা ও শরীয়াহ-ভিত্তিক আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত। রাজতন্ত্রে এসব মূলনীতি অনুপস্থিত বা সীমিত—নেতৃত্ব হয় বংশানুক্রমিক, সিদ্ধান্ত হয় একক, আর আইন চলে শাসকের ইচ্ছানুযায়ী। ইনসাফও থাকে শাসকের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তাই রাজতন্ত্র কিভাবে ইসলামসম্মত হতে পারে, যখন তা ইসলামী নীতিমালার অনুগত না হয়ে স্বেচ্ছাচারিতাকে রাষ্ট্রীয় জীবনে লালন করে।
*৯. উপসংহার:* ইসলামে শাসনব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের কল্যাণ।
রাজতন্ত্র ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কি অবৈধ এমন উত্তর খোঁজার আগে যদি আমরা এর কার্যপ্রণালী, নৈতিক চরিত্র এবং আইনপ্রণয়ন পদ্ধতি ইসলামি নীতিমালার সাথে তুলনা করি, তাহলে দেখব, রাজতন্ত্রের নীতিমালা ইসলামের সাথে পরিপন্থী, আর এই কারণেই রাজতন্ত্র প্রত্যাখ্যাত।
এই আলোকে, মুসলিম উম্মাহর সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এমন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা আল্লাহর বিধানের অনুগত, জনগণের প্রতি জবাবদিহিমূলক, জনগণের কল্যাণ এবং ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করে। (মূসা: ০২-০৮-২৫)
প্রধান উপদেষ্টাঃ ফরহাদ মাজহার
উপদেষ্টাঃ এস,এম নজরুল ইসলাম ভুইয়া
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আবুল হাসেম
উপ সম্পাদকঃ এম, আসমত আলী মিসু
সহঃসম্পাদকঃ আলী নওয়াব খোকন
বার্তা সম্পাদকঃ ইয়াছিন আরাফাত
সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদকঃ আসাদুজ্জামান খান মুকুল
www.dainikbanglarsangbad.com
ইমেইলঃ dainikbanglarsangbad490@gmail.com
প্রধান কার্যলয়ঃ বাড়ি নং ৩৫, রোড নং-৪, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইলঃ01736-091515, 01716-698621
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Copyright © 2025 dainikbanglarsangbad.com. All rights reserved.