ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*ইসলামি চার মাজহাব: ইতিহাস, আলোচনা*
*বিশ্লেষণ ও সমন্বয়*
_(আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আলোকে বিশ্লেষণ)_
*১. ভূমিকা:*
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহ। এই দুটি ভিত্তির ওপর ইসলামের আইনব্যবস্থা তথা শরিয়াহ গড়ে উঠেছে। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তিকালের পর নতুন বাস্তবতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সমস্যার উদ্ভব হয়, যার সমাধানে প্রয়োজন পড়ে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাচর্চা এবং আইনি ব্যাখ্যার। এই ধারাবাহিকতায় ইসলামী চিন্তাবিদ ও ফকীহগণ ফিকহ শাস্ত্র বিকাশ করেন এবং চারটি সুন্নি মাজহাবের (হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি, হাম্বলি) উদ্ভব ঘটে।
এই প্রবন্ধে আমরা এই চার মাজহাবের বিকাশ, সমালোচনা, এবং মাজহাবের মধ্যে সমন্বয়ের প্রস্তাব উপস্থাপন করব আইন, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ– এই চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে। পাশাপাশি আলোচনা করব, কেন “মুসলিম” পরিচয়ই যথেষ্ট, এবং মাজহাবি বিভাজন কিভাবে মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করছে।
আরও পড়ুনঃ “দাজ্জাল” শুধু একজন ব্যক্তি না – সে একটা পূর্ণ ‘সিস্টেম’
*২. চার মাজহাবের ইতিহাস ও বিকাশ: একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ:*
_২.১ হানাফি মাজহাব:_ প্রতিষ্ঠাতা: ইমাম আবু হানিফা (৮ম শতাব্দী)। অঞ্চল: ইরাক, ভারত, বাংলাদেশ, তুরস্ক। বৈশিষ্ট্য: যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা, কিয়াস ও ইস্তেহসানের ব্যবহার। সমাজ-সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়নে অগ্রগণ্য।
_২.২ মালিকি মাজহাব:_ প্রতিষ্ঠাতা: ইমাম মালিক (মুয়াত্তা গ্রন্থের রচয়িতা)। অঞ্চল: মদিনা, উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা। বৈশিষ্ট্য: মদিনাবাসীর আমলকে দলীল হিসেবে গ্রহণ। প্রথা ও ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেয়।
_২.৩ শাফেয়ি মাজহাব:_ প্রতিষ্ঠাতা: ইমাম আশ-শাফেয়ি। অঞ্চল: মিসর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া। বৈশিষ্ট্য: উসূলুল ফিকহের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। দলীলভিত্তিক সুসংহত পদ্ধতি।
_২.৪ হাম্বলি মাজহাব:_ প্রতিষ্ঠাতা: ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল। অঞ্চল: সৌদি আরব, কুয়েত। বৈশিষ্ট্য: সহীহ হাদীসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। কুরআন ও সুন্নাহর সরাসরি অনুসরণে অগ্রগামী।
*৩. আইন ও নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে:*
চার মাজহাব ইসলামী আইনকে বহুমাত্রিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এসব মাজহাব ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ব্যবসায়িক এবং বিচারব্যবস্থায় গভীর প্রভাব রেখেছে। রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নেও এগুলোর অবদান ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নীতিগতভাবে, মাজহাবগুলো সমাজে ন্যায়, শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছে। সমাজের নানা সমস্যা ও বিভ্রান্তির মধ্যে তারা নৈতিক ও ধর্মীয় স্থিতি বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে।
*৪. নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে:*
প্রত্যেক ইমাম ছিলেন নীতিনিষ্ঠ, পরহেজগার ও সত্যনিষ্ঠ চিন্তাবিদ। তারা কখনোই নিজস্ব মতকে চূড়ান্ত সত্য মনে করেননি। বরং তারা বারবার বলেছেন—“আমার কথার চেয়ে দলীল শক্তিশালী হলে তা গ্রহণ কর।” এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামে আত্মনির্ভরশীলতা, চিন্তাশীলতা ও সত্যানুসন্ধানের শিক্ষা দেয়।
তবে পরবর্তীকালে অনেক অনুসারী এই চেতনাকে বিস্মৃত হয়ে শুধুমাত্র মাজহাবকে একমাত্র পথ হিসেবে গ্রহণ করেন, যা অন্ধ আনুগত্য এবং বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে।
*৫. মাজহাবের প্রতি সমালোচনামূলক মূল্যায়ন:*
_৫.১ অন্ধ অনুসরণ (তাকলিদ):_ দলীল যাচাই না করে শুধুমাত্র ইমামদের বাণীকে চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করা। এই মনোবৃত্তি পরিহার করতে হবে!
_৫.২ মতপার্থক্যের কঠোরতা:_ নিজেদের মাজহাব ব্যতীত অন্যদের বাতিল বলা। এই মনোভাব পরিহার করতে হবে!
_৫.৩ ইজতিহাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া:_ নতুন সমস্যার জন্য নতুন সমাধান না খোঁজা। ইজতিহাদের দরজা খোলা রাখতে হবে!
_৫.৪ রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রভাব:_ শাসকগোষ্ঠীর চাপ ও প্রভাবের ফলে মাজহাবের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হওয়া। নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে এবং কুরআন ও সুন্নাহকে সবক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে!
*৬. মাজহাবের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রস্তাব:*
_৬.১ মৌলিক ঐক্যের স্বীকৃতি:_ চার মাজহাব একই কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহর অনুসারী। মতপার্থক্য মূল নয়, শাখা।
_৬.২ দলীল ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি:_ ইজতিহাদ এবং দলীল যাচাইকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
_৬.৩ আন্তঃমাজহাব শ্রদ্ধা:_ অন্য মতের প্রতি সহনশীলতা ও আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
_৬.৪ আধুনিক ফিকহি সংলাপ:_ আন্তর্জাতিক ফিকহি একাডেমির মতো মঞ্চে সব মাজহাবের আলেমদের অংশগ্রহণে সময়োপযোগী সমাধান তৈরি করা।
আরও পড়ুনঃ মধুপুর পৌর সভার ৪,৫ও ৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত
*৭. মুসলিম পরিচয়ের শুদ্ধতা ও সতর্কবার্তা:*
আমার পরিচয় “মুসলিম”—এই পরিচয়ই আমার জন্য যথেষ্ট। ইসলাম চায় পরিচয় হোক আল্লাহর দাসত্বভিত্তিক, দলীয় পরিচয়ভিত্তিক নয়। আজ অনেকেই মাজহাবকে নিজেদের একমাত্র পরিচয় মনে করে নিজেদের “হানাফি মুসলিম, মালিকি মুসলিম, শাফেয়ি মুসলিম বা হাম্বিলি মুসলিম ইত্যাদি বলে পরিচিত করে তোলেন, যা কুরআনের ঐক্যের বাণীর পরিপন্থী।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাদীসে উল্লেখ করেছেন—এই উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, যার মধ্যে কেবল একটি দল হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে—যারা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণে অটল থাকবে। অতএব আমাদের অবশ্যই নিজেকে “মুসলিম” পরিচয়ে গর্বিত মনে করতে হবে এবং মাজহাবকে বুঝার পদ্ধতি হিসেবে নিতে হবে, দল বা বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে নয়। অন্যথায় আমরা অজান্তেই ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জাহান্নামের পথকে আলিঙ্গন করতে পারি।
*৮. উপসংহার:*
চার মাজহাব ইসলামী আইন, নীতি ও মূল্যবোধের বিকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। এরা ইসলামী সমাজকে চিন্তাশীল, বিশ্লেষণধর্মী ও ন্যায়নিষ্ঠ পথ দেখিয়েছে। তবে যখন এগুলোকে বিভক্তির মাধ্যম, অথবা একমাত্র সত্য পথ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তখন তা ইসলামের ঐক্য, উদারতা ও সত্যনিষ্ঠতার পরিপন্থী হয়ে পড়ে।
আজকের দুনিয়ায় মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো—দলীলভিত্তিক চিন্তা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ইজতিহাদের চর্চা এবং মুসলিম পরিচয়ের পুনরুদ্ধার। মাজহাব হোক ইসলাম বুঝার সহায়ক পদ্ধতি, বিভাজক নয়।
"মুসলিম" পরিচয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ'লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ'লামীন*। (মূসা: ০৬-০৭-২৫)
প্রধান উপদেষ্টাঃ ফরহাদ মাজহার
উপদেষ্টাঃ এস,এম নজরুল ইসলাম ভুইয়ামোঃ আমিনুল ইসলাম,
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আবুল হাসেম,
সহঃসম্পাদকঃ আলী নওয়াব খোকন,
বার্তা সম্পাদকঃ ইয়াছিন আরাফাত,
সহকারী বার্তা সম্পাদকঃ এম, আসমত আলী মিসু,
সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদকঃ আসাদুজ্জামান খান মুকুল,
www.dainikbanglarsangbad.com
ইমেইলঃ dainikbanglarsangbad490@gmail.com
প্রধান কার্যলয়ঃ বাড়ি নং ৩৫, রোড নং ৪, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইলঃ01736091515, 01716698621
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Copyright © 2025 dainikbanglarsangbad.com. All rights reserved.