ডাঃ এম, জি, মোস্তফা মুসাঃ
*আল-কুরআনে খ্রিষ্টধর্মের ত্রিত্ববাদ (Trinity)-এর অসারতা প্রমাণ:*
_(ত্রিত্ববাদের ভ্রান্তি: আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ)_
_ভূমিকা:_ মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সত্য হলো তাওহীদ, এক আল্লাহর একত্ব। এই তাওহীদের বাণীই সমস্ত নবী ও রাসূলদের মিশনের মূল ছিল। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শয়তান মানুষের অন্তরে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য বহু ষড়যন্ত্র করেছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ত্রিত্ববাদ (Trinity), একের ভিতরে তিন—যা খ্রিষ্টধর্মের এক কেন্দ্রীয় বিশ্বাস। তিন সত্তা অথচ এক সত্তা—এই তত্ত্ব যুক্তি, আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তির সব নিয়মের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
কুরআন এসেছে এই ত্রিত্ববাদ (Trinity)-এর বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে। সূরা ইখলাসের স্রোতধারায় উচ্চারিত হয়েছে—“কুল হুয়াল্লাহু আহাদ”—বল, আল্লাহ এক। কুরআন অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করেছে, ঈসা (আ.) মহান নবী ও রাসূল, কিন্তু তিনি কখনো স্রষ্টা নন, বরং সৃষ্ট। এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে—আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দর্শন এবং বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে কেন ত্রিত্ববাদ অসঙ্গত, এবং কিভাবে শয়তান এই বিভ্রান্তির পেছনে সক্রিয় থেকেছে।
*১. আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে:* আইন একটি রাষ্ট্র বা সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার উপায়। আইনের মূল নীতি হলো সংঘাতমুক্ততা (non-contradiction)—একটি বিষয় একইসঙ্গে সত্য এবং অসত্য হতে পারে না। খ্রিষ্টধর্মের ত্রিত্ববাদ বলে: তিনজন আল্লাহ আছেন, অথচ তারা এক আল্লাহ। এটি আইন ও যুক্তির বুনিয়াদী নীতি লঙ্ঘন করে। কারণ 'একের মধ্যে তিন' এবং 'তিনের মধ্যে এক' থাকা বাস্তবে লজিক্যাল কনফ্লিক্ট। আইনত ও চুক্তি বা শর্তাবলী এমন হতে হয়, যা স্পষ্ট, নির্ভুল এবং দ্ব্যর্থহীন। ত্রিত্ববাদ এই স্পষ্টতা নষ্ট করে।
আরও পড়ুনঃ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ( পিআর ) পদ্ধতির নির্বাচনের যত মন্দ দিক এবং সহিংসতা বেড়ে যাবার আশঙ্কা
*২. নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে:* নীতির মূল ভিত্তি হলো ন্যায় ও সমতা। এক সত্তার মধ্যে তিনটি আলাদা সত্তা থাকা ন্যায় ও সমতার নীতি পরিপন্থী। কারণ এতে ঈশ্বরত্বের মধ্যে স্তর বিভাজন দেখা দেয়—যেমন পিতা সর্বশক্তিমান, পুত্র অবাধ্য হতে পারে, আত্মা মধ্যস্থতাকারী ইত্যাদি। ইসলাম এককত্বের মাধ্যমে ন্যায়ের শিখর প্রতিষ্ঠা করেছে—আল্লাহ এক, একক, অদ্বিতীয়।
*৩. নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে:* নৈতিকতা শিক্ষা দেয়—সত্য বলতে যা বোঝানো হয়, তা হওয়া উচিত স্পষ্ট, সহজবোধ্য এবং সর্বসাধারণের বোধগম্য। ত্রিত্ববাদ সাধারণ মানুষের কাছে চরম বিভ্রান্তিকর। একজন সাধারণ মানুষ কখনো বুঝতে পারে না, ঈসা (আ.) একইসঙ্গে আল্লাহ, আবার আল্লাহর পুত্রও! এটি নৈতিকভাবে সত্য গোপন রাখার সামিল।
*৪. মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে:* ইসলামে তাওহীদ হলো সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ। ত্রিত্ববাদ সেই ভিত্তিকেই নষ্ট করে দেয়। এক আল্লাহর উপাসনা মানুষকে অহঙ্কারমুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল ও দায়িত্বশীল করে তোলে। ত্রিত্ববাদ সেই সরলতা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়, যার ফলে মানুষের মনোজগত বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।
*৫. দর্শনের আলোকে:* দর্শনের এক মৌলিক নীতি হলো যুক্তির অখণ্ডতা (coherence of logic)। যা যুক্তি মেনে চলে না, তা সত্য হতে পারে না। দর্শন বলে: এক একক সত্তা। তিন তিন পৃথক সত্তা। ত্রিত্ববাদ যুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দর্শন বলে: Contradictory propositions cannot both be true. অর্থাৎ, কোনো বিষয় একইসঙ্গে তিন এবং এক হতে পারে না। ইসলামিক দর্শনে আল্লাহর একত্ব যুক্তির শীর্ষ বিন্দু। ত্রিত্ববাদ সেই যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক, তাই দর্শনও ত্রিত্ববাদকে বাতিল করে।
আরও পড়ুনঃ মহাদেবপুরে শিক্ষার্থীদের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধকরণ বিষয়ক মতবিনিময় সভা
*৬. উপসংহার (এই অংশের):* ত্রিত্ববাদ, আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং দর্শনের আলোকে সম্পূর্ণ অসঙ্গত, অবাস্তব এবং অযৌক্তিক। এটি মানুষের ঈমানের সরলতা ও বিশুদ্ধতা বিনষ্ট করে। ইসলাম এই বিভ্রান্তি দূর করে এক অটল বার্তা দেয়: ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’। ‘বল, আল্লাহ এক।” (সূরা ইখলাস, ১১২:১)। এই একত্বই মানবজাতির একমাত্র মুক্তির পথ।
*ত্রিত্ববাদ চালু করার পেছনে শয়তানের ভূমিকা:*
*১. শয়তানের চরম লক্ষ্য শিরক প্রতিষ্ঠা করা:* ইসলামের দৃষ্টিতে শয়তানের চরম লক্ষ্য হলো—মানুষকে আল্লাহর একত্ব থেকে বিচ্যুত করা। কুরআনে শয়তান বলেছে: “হে আমার রব্ব, যেহেতু আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করেছেন, আমি অবশ্যই তাদের (মানুষের) জন্য পৃথিবীতে সবকিছু শোভনীয় করে তুলব এবং অবশ্যই তাদের সকলকে বিভ্রান্ত করব।” (সূরা হিজর, ১৫:৩৯)। শয়তান জানে, তাওহীদ বা একত্ববাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো শিরক। তাই সে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য এমন বিশ্বাস প্রবর্তন করতে চেয়েছে, যাতে মানুষ এক আল্লাহর ইবাদাত থেকে সরে আসে।
*২. মানুষের আবেগ-অনুভূতির অপব্যবহার:* শয়তান মানুষের এক দুর্বল দিক চমৎকারভাবে চেনে—আবেগ। মানুষ এমন ব্যক্তিকে বিশেষ মর্যাদা দিতে ভালোবাসে, যিনি অলৌকিক কাজ করেন, দুঃখ দূর করেন, বা তাদের জীবনে পরিবর্তন আনেন। ঈসা (আ.)-এর অলৌকিক জন্ম, মুজিজা, মৃতকে জীবন্ত করা ইত্যাদি দেখে শয়তান মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিল যে, তিনি আল্লাহর পুত্র বা ঈশ্বরের অংশ। এভাবে মানুষের আবেগ-ভক্তি ধর্মান্তরিত হয়ে পড়ল শিরকে।
আরও পড়ুনঃ শিক্ষার্থীদের মাঝে স্কুল ড্রেস বিতরণ করেছে সৈয়দ হারুন ফাউন্ডেশন
*৩. তাওহীদের সরলতা জটিল করে তোলা:* তাওহীদ অত্যন্ত সরল: আল্লাহ এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, তিনি জন্ম দেন না, জন্ম নেন না। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। শয়তান চেয়েছিল এই সরল সত্যকে জটিল করতে। তাই “ত্রিত্ববাদ” প্রবর্তন হলো শয়তানের এক কৌশল, যাতে মানুষ বলে: ঈসা (আ.) ঈশ্বরের পুত্র; আবার তিনিই ঈশ্বর; আবার পবিত্র আত্মা (Holy Spirit) ও ঈশ্বর। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং সহজ তাওহীদ থেকে দূরে সরে যায়।
*৪. ভ্রান্ত ধর্মীয় নেতাদের প্ররোচনা:* ইসলামী ঐতিহাসিক সূত্রে উল্লেখ আছে, শয়তান ধর্মীয় পণ্ডিত ও নেতাদের প্ররোচনা দেয় যেন তারা নিজের ক্ষমতা ও মর্যাদা রক্ষার্থে ঈসা (আ.)-এর মর্যাদা অতিরঞ্জিতভাবে তুলে ধরে। শয়তান তাদের মনে করিয়ে দেয়: “মানুষের উপর প্রভাব রাখতে হলে ঈসা (আ.)-কে ঈশ্বর বলো। মানুষ তোমাদের কথা শুনবে।” এইভাবে, ঈসা (আ.)-এর আসল পরিচয় বিকৃত হলো।
*৫. মানুষকে কিয়ামতের দিন সর্বনাশের পথে ধাবিত করা:* শয়তান চায় মানুষ এমন অপরাধ করুক, যা আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না—শিরক। কুরআনে বলা হয়েছে: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক ক্ষমা করেন না, আর তা ছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।” (সূরা নিসা, ৪:৪৮)। ত্রিত্ববাদ শয়তানের এক চরম ষড়যন্ত্র, যাতে মানুষ শিরক করে এবং আখেরাতে চিরস্থায়ী শাস্তির পাত্র হয়।
আরও পড়ুনঃ কালীগঞ্জে খেলার মাঠ উদ্বোধন করায় আনন্দে উল্লাসে মাতোয়ারা গ্রামের যুব সমাজ
*৬. উপসংহার:* ত্রিত্ববাদ এক ভয়ংকর বিভ্রান্তি, যা মানুষের সহজ-সরল ফিতরাতকে জটিল করে তোলে। এটি শুধু ধর্মীয় বিভ্রান্তিই নয়, বরং যুক্তির, নৈতিকতার এবং মানবিক মূল্যবোধেরও চরম লঙ্ঘন। ত্রিত্ববাদ চালু হওয়ার পেছনে শয়তানের ভূমিকা স্পষ্ট—মানুষকে তাওহীদের সরল পথ থেকে সরিয়ে, বিভ্রান্তিতে ফেলে, শিরকের গভীরে ডুবিয়ে দেওয়া। কুরআন আমাদের বারবার সতর্ক করেছে—আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়। তিনি কারো পিতা নন, কারো পুত্র নন, কারো অংশ নন। মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ—তাওহীদ।
তাই আমাদের দায়িত্ব, শয়তানের এই জটিল ফাঁদ থেকে নিজেকে, পরিবারকে এবং সমাজকে রক্ষা করা এবং দৃঢ়ভাবে বলতে থাকা, ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’। এই একত্বই মানবজাতির নাজাত এবং প্রকৃত মুক্তির পথ। ইসলাম বারবার সতর্ক করেছে, যেন শয়তানের এই কৌশল থেকে মানুষ সজাগ থাকে। তাই আমাদের দায়িত্ব—আল্লাহর একত্বের উপর অটল থাকা এবং কোনোভাবেই ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র বা অংশীদার মনে না করা।
*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ'লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ'লামীন*। (মূসা: ১৭-০৭-২৫)
প্রধান উপদেষ্টাঃ ফরহাদ মাজহার
উপদেষ্টাঃ এস,এম নজরুল ইসলাম ভুইয়া
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আবুল হাসেম
উপ সম্পাদকঃ এম, আসমত আলী মিসু
সহঃসম্পাদকঃ আলী নওয়াব খোকন
বার্তা সম্পাদকঃ ইয়াছিন আরাফাত
সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদকঃ আসাদুজ্জামান খান মুকুল
www.dainikbanglarsangbad.com
ইমেইলঃ dainikbanglarsangbad490@gmail.com
প্রধান কার্যলয়ঃ বাড়ি নং ৩৫, রোড নং-৪, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইলঃ01736-091515, 01716-698621
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Copyright © 2025 dainikbanglarsangbad.com. All rights reserved.